পানশির প্রদেশের বিদ্রোহীদের পরাজিত করা এবং নতুন আফগান সরকার ঘোষণার মাধ্যমে দুটি ঘটনা ঘটল। আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটোর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল পরাজয়ের মাধ্যমে। পাঁচবার চেষ্টা করেও সোভিয়েতরা পানশিরে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু তালেবানদের জন্য ব্যাপারটা ততটা কঠিন হয়নি। বিদ্রোহীদের শেষ দুর্গের পতনের মাধ্যমে শেষ হলো অ-তালেবান যুদ্ধনায়ক বা ওয়ারলর্ডদেরও যুগ। আর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে তালেবান আন্দোলন প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে রক্ষণাত্মক গৃহস্থে পরিণত হলো। গৃহস্থের মতোই তাদের এখন ঘর সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে হবে।
কিন্তু সরকার গঠনে এত দেরির কারণ কী ছিল?
কাবুলসহ পুরো আফগানিস্তান তালেবানদের দখলে এলেও পানশির ছিল গলার কাঁটা। ওই প্রদেশকে ‘মুক্ত’ না করে তালেবানরা নিজেদের ‘জাতীয় নেতা’ হিসেবে দেখাতে পারছিল না। তালেবানরা প্রথমে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা চেয়েছিল। কিন্তু নতুন সরকারের ৩০ ভাগ পদ দাবি করে বসায় আলোচনার চেয়ে বলপ্রয়োগই কম খরুচে ব্যাপার বলে সাব্যস্ত করে তালেবানরা। পানশিরের দুই ওয়ারলর্ড ছিলেন বিতাড়িত গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্টে আমরুল্লাহ সালেহ এবং পানশিরের সিংহ নামে পরিচিত আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র আহমদ মাসুদ। উভয়ই ছিলেন সিআইএর তৈরি করা লোক। মার্কিন মদদেই তাঁরা ‘বিদ্রোহী’ ভূমিকা পালন করছিলেন। এখন উভয়ই প্রেসিডেন্ট গনির মতো তাজিকিস্তানে পলায়ন করেছেন। পলায়ন করেছেন জেনারেল দোস্তামও।
সরকার গঠনে দ্বিতীয় বাধা ছিল তালেবান নেতাদের মধ্যকার মতবিরোধ। মাঠে যুদ্ধ করা কমান্ডারদের সঙ্গে দোহা-নিবাসী রাজনীতিক-কূটনীতিকদের মিল হচ্ছিল না।
কমান্ডারদের হয়ে কথা বলছিলেন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের পুত্র মোল্লা ইয়াকুব। তিনি তালেবান মিলিটারি কমিশনের প্রধান। মাঠের যোদ্ধাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তাঁরই অধীনে। তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যেও এই যুবক বিপুলভাবে জনপ্রিয়। ইয়াকুব তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘দোহায় বিলাসী জীবন যাপনকরণেওয়ালারা’ ময়দানের বাস্তবতা কী বুঝবে? ইয়াকুব পাকিস্তানি আইএসআই-এর ঘনিষ্ঠ হাক্কানি নেটওয়ার্ককেও পছন্দ করেন না।
ইয়াকুবদের এই বিরোধিতাকে দেখা হচ্ছে আফগান জাতীয়তাবাদী বনাম পাকিস্তানপন্থীদের বিরোধ হিসেবে। ইয়াকুবের অপছন্দের খলিল হাক্কানিই কাবুলের নিরাপত্তা দেখছিলেন। তাঁকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না করে যে শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী করা হলো, তা সম্ভবত জাতীয়তাবাদীদের বাধার কারণেই। আর মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
কিন্তু অনেকেরই চোখে লাগার কথা যে তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা বারদার আফগান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন না। দোহায় অবস্থিত তালেবানের রাজনৈতিক দপ্তরের শীর্ষ কূটনীতিক ছিলেন তিনি। বিলুপ্ত গনি সরকার এবং রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যকার আলোচনা তাঁর নেতৃত্বেই চলছিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুবের জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে আসা আপত্তির কারণেই বোধ হয় পাকিস্তানপন্থী বারদারের বদলে মোল্লা মোহম্মদ হাসান আকন্দ ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হলেন। কিন্তু উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোল্লা আবদুল গনি বারদার ক্ষমতাকেন্দ্রেই রইলেন এবং স্থায়ী সরকার পত্তন হলে তাঁর আবার কেন্দ্রে চলে আসার সম্ভাবনা থাকছে।
তালেবান সুন্নি মুসলিম হলেও ইরানি কায়দায় ক্ষমতা বিন্যাসের সম্ভাবনা প্রবল। আর তাহলে কান্দাহারের পাঠান আখুন্দজাদাই হবেন আফগান খোমেনি।
কিন্তু আসল ব্যক্তিটি আড়ালেই রইলেন। তিনি হলেন সুপ্রিম লিডার হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। আফগানিস্তান নিয়মতান্ত্রিক ইসলামি আমিরাত হয়ে উঠলে এই ইসলামি পণ্ডিতেরই সম্ভাবনা রয়েছে ক্ষমতার পিরামিডের শীর্ষ আসনে বসার। তালেবানের মজলিশে শুরার ১২ সদস্যই তাঁর অধীনে থাকবেন বলে ওয়াকিবহাল লেখকেরা বলছেন। তালেবান সুন্নি মুসলিম হলেও ইরানি কায়দায় ক্ষমতা বিন্যাসের সম্ভাবনা প্রবল। আর তাহলে কান্দাহারের পাঠান আখুন্দজাদাই হবেন আফগান খোমেনি।
এবং চমকের কিছু নেই যে আফগানিস্তানের নতুন সরকারের অভিষেকে আমন্ত্রিত ছিল রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইরান। তালেবানদের কাছে এদের সবার বিভিন্ন রকমের চাওয়া থাকলেও গড় চাওয়া একটাই। তা হলো নিরাপত্তা।
এমনিতে মধ্য এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক খুঁটি উপড়ে দিয়ে তালেবানরা এদের বিরাট উপকার করেছে। তারা এখন অন্যদিকে মনযোগ দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, আফগান মাটি থেকে কোনো সন্ত্রাসী হামলা বা তৎপরতা এসব দেশে না হওয়ার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে তালেবান। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের স্ববিরোধিতা হলো, মার্কিন অধিকৃত অঞ্চলেই বর্বর আইএস গ্রুপের উত্থান ঘটেছে। যখন আমেরিকা নেই ইরাকে বা সিরিয়ায় তখন আইএসও প্রায় নেই ওখানে। মার্কিন অধিকৃত আফগানিস্তানেও আইএসের আমদানি হয়েছিল। পাকিস্তানে যে কিছুটা আছে আইএস, সেটাও সিআইএ ওই দেশে ব্যাপক সক্রিয় বলেই। এমনটাই মনে করেন ভারতীয় ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিক এম ভদ্রকুমার। স্বাভাবিকভাবেই তালেবান আইএসকে কোনো সুযোগই দেবে না। এমনকি আফগান শরণার্থীদের তুরস্কে বা ইরানে যাওয়া ঠেকিয়ে দেশ দুটিকে স্বস্তি দেওয়াও তালেবানি কৌশল।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আগের মতো আমেরিকার তালে নাচছে না। জার্মানি তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। ইতালিও আছে সেই সারিতে। চীন কেবল তালেবানদের রক্ষক হিসেবেই নেই ৪ বিলিয়ন ডলারের ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তিও তার করতে যাচ্ছে আফগানিস্তানের সঙ্গে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট সাংহাই কো–অপারেশন কাউন্সিলেও আফগানিস্তানকে নিতে চাইছে তারা।
রাশিয়ার উদ্বেগের জায়গাও রয়েছে। যদি তালেবানরা নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আনে, যদি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে, তাহলে মধ্য এশিয়ার ‘স্তান’ রাষ্ট্রগুলো, যেমন তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান প্রভৃতি আর নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। কিন্তু রাশিয়া জানে রুটির কোনদিকে মাখন মাখানো। তাই তালেবানদের মেনে নিতে তারা দেরি করেনি।
তালেবানের জন্য সমস্যা বাধাচ্ছেন তাজিকিস্তানের প্রবীণ স্বৈরশাসক ইমোমালি রাহমন। তিনি তালেবানদের ঘোরতর বিরোধী। আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশই তাজিক হওয়ায় তাঁর হাতে গুরুত্বপূর্ণ কার্ড থাকছে। যদিও পানশিরের তাজিক বিদ্রোহীরা তাজিকিস্তানের সাহায্য নেয়নি। কিন্তু রাহমনের কঠোর বিবৃতি তাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্ব দিয়েছে। গত ৩০ আগস্ট ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ রাহমনকে প্যারিস সফরের দাওয়াতও দিয়ে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র যদি তালেবানবিরোধী নতুন খেলায় নামে, তাহলে তাজিকিস্তান হতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তুরুপের তাস।
বিপুল দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে। এই মাত্রার মেধা পাচার আফগান সরকারের দক্ষতায় ঘাটতি আনতে পারে। ওদিকে গনি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা কোষাগার লুট করে গেছে। আমেরিকা আটকে দিয়েছে নয় বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, আরোপ করেছে অবরোধ। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। প্রচণ্ড ব্যয়বহুল সামরিক অভিযানের বদলে তারা এখন নিতে পারে হাইব্রিড যুদ্ধের কৌশল। বোমা হামলা, সন্ত্রাসী অন্তর্ঘাত, ড্রোন হামলা আবার দেখা যেতে পারে।
কিন্তু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আগের মতো আমেরিকার তালে নাচছে না। জার্মানি তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। ইতালিও আছে সেই সারিতে। চীন কেবল তালেবানদের রক্ষক হিসেবেই নেই ৪ বিলিয়ন ডলারের ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তিও তার করতে যাচ্ছে আফগানিস্তানের সঙ্গে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট সাংহাই কো–অপারেশন কাউন্সিলেও আফগানিস্তানকে নিতে চাইছে তারা। ইরানও চায় আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে মধ্য এশিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগ। কাতারও আসছে টাকার বস্তা নিয়ে।
তালেবানরা টিকে যেতে পারে এক শর্তে। প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে ব্যবসা ও নিরাপত্তার জোগানদার হয়ে ওঠার মাধ্যমে। দিনের শেষে মানুষ মতবাদ বা বীরত্ব নয়, শান্তি ও সমৃদ্ধি চায়। আসলে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যই তারা মতবাদ ও বীরত্ব খোঁজে। সেই চীনা প্রবাদে কে না বিশ্বাস করে যে, বিড়াল সাদা হোক বা কালো হোক, ইঁদুর ধরতে পারে কি না, সেটাই আসল ব্যাপার।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।