আফগান শরণার্থী আশরাফদের যেভাবে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হয়

অবৈধভাবে তুরস্কে প্রবেশের দায়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক একটি আফগান পরিবার
ছবি: রয়টার্স

জয়তুনবুরনু বসফরাসতীরের অন্যতম একটি ব্যস্ত এলাকা। চমৎকার সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহারের পাশাপাশি প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি দেশের শরণার্থীদের বসবাস জয়তুনবুরনুকে মুড়িয়ে দিয়েছে সীমাহীন বৈচিত্র্যের চাদরে। তাদের বিশাল একটি অংশ আফগানি। রাষ্ট্রীয় চোখে ‘অবৈধ’। কাগজপত্র নেই। পুলিশও মোটাদাগে ধরপাকড় এড়িয়ে যায়। রাষ্ট্র ও শরণার্থীদের এই পারস্পরিক ‘অসম’ সম্পর্কের ক্রিয়াপ্রণালিতে তুরস্কের সিএনএন তুর্ক চ্যানেলে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধু ভলকানের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। এই আগ্রহ নিবারণে আফগানিদের নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত হওয়ার জন্য নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অবশেষে গত গ্রীষ্মে ‘হ্যাঁ বলেছিলাম’ নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকার শর্তে।

মাঠকর্মের প্রথম দিনেই বিপুলসংখ্যক আফগানির ক্রিকেট ম্যাচের এলাহি আয়োজন দেখলাম জয়তুনবুরনুর সমুদ্রতীরে। এই আফগানি দলের নেতা ও অভিভাবক জালাল। ঐতিহাসিক বলখ শহরের বাসিন্দা তিনি। বছরখানেক আগে জালাল বন্ধুদের সমান ভাগীদার রেখে জয়তুনবুরনুতে খুলেছে ব্যাগের কারখানা। অনেকটা ঢাকার জিঞ্জিরার কায়দায় ক্রিশ্চিয়ান ডিওর থেকে শুরু করে ভালেন্তিন, পশ্চিমের দামি দামি ব্র্যান্ডের ব্যাগ জালালের কারখানায় তৈরি হয়ে যায় মুহূর্তেই। সখ্য বৃদ্ধির দরুন মাঠকর্মের পরবর্তী দিনগুলোতে জালালি গ্রুপের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতাম। আর ভলকান সেই ম্যাচের সময়ে ক্যামেরাবন্দী করে নিয়েছিল তথ্যচিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছু।

দুই
গ্রীষ্ম শেষ। মাঠকর্মও শেষ। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ভলকানের তৈরি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার হয়েছে স্থানীয় সিএনএন তুর্ক চ্যানেলে। গত সপ্তাহে অনেকটাই অদৃষ্ট তাড়িত হয়ে আবার গিয়েছিলাম জয়তুনবুরনুতে। কিন্তু জালাল দলবলসহ উধাও। নিদারুণ ঝক্কিঝামেলা শেষে খোঁজ মিলল তাঁদের। পাঁচতলা ভবনের বেসমেন্ট, সবাই সমবেত জালালের ঘরে। খসখসে সবুজ দেয়ালে হেলান দিয়ে কোরআন পড়ছিলেন জালাল, বন্ধুদের কেউ ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলেন, কেউবা আগরবাতির নির্মল ধোঁয়ার সামনে বসে ছিলেন নিঃসাড় হয়ে। ঘরের মেঝেতে ইরানি সবুজ গালিচায় সূর্যের কিরণের প্রতিবিম্বে সৃষ্টি হয়েছিল এক বেদনাময় বিকেল। তাঁদের একজন আত্মহত্যা করেছেন। নাম আশরাফ। জালালের ব্যাগের দোকানেই তিনি কাজ করতেন। সাপ্তাহিক আয়ও ছিল বেশ ভালো। আত্মহত্যার আগের দিনও আশরাফ কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন, সন্ধ্যায় জয়তুনবুরনুর সমুদ্রতীরে বসে উপভোগ করেছিলেন রাতের সমুদ্র, বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছিলেন ক্রিকেটও। স্থানীয় পুলিশ লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বলখে পাঠিয়েছে আশরাফের লাশ। আসলেই কি আত্মহত্যা ছিল, নাকি ধীরে ধীরে আশরাফদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে আত্মহত্যার দিকে, নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এই খটকা আমার দীর্ঘদিনের।

তিন
টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর দুনিয়াজুড়ে মার্কিনিরা আরম্ভ করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ নামক এক বিভীষিকা। এই যুদ্ধ-বিভীষিকা বোমা, ট্যাংক আর ড্রোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিস্তৃত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডের নানান শাখায়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ ডিসকোর্স কিংবা চিন্তাধারায় একটি জনগোষ্ঠীকে হাজির করা হয় সন্ত্রাসী, আধুনিকতাবিরোধী ও অসভ্য হিসেবে। হলিউডের সিনেমাতে খারাপ, অসভ্য মানুষ হিসেবে চিত্রিত করা হয় আরব ও মুসলিমদের। সবুদ করার চেষ্টা করা হয় দেড় হাজার বছর বয়সী ইসলামকে মানবতাবিরোধী ধর্ম হিসেবে। অপরাধী করা হয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপকরণগুলোকে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী গার্গী ভট্টাচার্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধকে দেখেছেন মানুষের মূল্যবোধ, চেতনা এবং জীবনযাত্রা প্রণালির ওপর হামলা হিসেবে।

অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো মার্কিনিদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ ভয়াবহতা কিঞ্চিৎ কাটিয়ে উঠলেও ইরাক এবং আফগানিস্তানের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়েছে মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতা। দারিদ্র্য, অহরহ হামলা ও আশাহীনতা ধূলিসাৎ করেছে আফগানিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে। সম্ভবত স্বজন হারানোর ক্ষতমুক্ত কোনো পরিবার অবশিষ্ট নেই আফগানিস্তানে।

লাগাতার এই কুখ্যাত চিত্রায়ণ এমন শোচনীয় বাস্তবতা নির্মাণ করেছে যে চাইলেই পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাস দমনের অজুহাত দেখিয়ে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় কিংবা অন্যান্য দেশে হামলা চালাতে পারে হরহামেশাই। নির্দ্বিধায় বধ করতে পারে তথাকথিত সন্ত্রাসী ও সাধারণ মানুষদের। আইন-কানুন, সবুদ কিংবা কৈফিয়ত নিষ্প্রয়োজন।

চার
অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো মার্কিনিদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ ভয়াবহতা কিঞ্চিৎ কাটিয়ে উঠলেও ইরাক এবং আফগানিস্তানের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়েছে মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতা। দারিদ্র্য, অহরহ হামলা ও আশাহীনতা ধূলিসাৎ করেছে আফগানিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে। সম্ভবত স্বজন হারানোর ক্ষতমুক্ত কোনো পরিবার অবশিষ্ট নেই আফগানিস্তানে। এই স্বজনেরা হয় নিহত হয়েছেন কুখ্যাত গুয়ানতানামো বন্দিশিবিরে কিংবা বাগরাম সেনা ঘাঁটিতে নির্যাতনে অথবা স্বদেশে মার্কিনিদের নৃশংস ড্রোন হামলায়। তছনছ হয়েছে কোটি কোটি মানুষের জীবন। ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে স্বপ্নগুলো।

পশ্চিমা এই আধুনিক সন্ত্রাস এবং নৃশংস ড্রোন হামলা থেকে বেঁচে থাকার আকুতি আফগানিদের জন্মভূমি থেকে দূরে পৃথিবীর নানান দেশে দেশান্তরিত করলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে মুক্তি দেয়নি মার্কিন সন্ত্রাসের ভয়াবহতা থেকে। এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, হতাশা, অনাহার আর পুলিশি হয়রানির দরুন সৃষ্ট দুর্বিষহ পরিস্থিতির কাছে পরাস্ত হয়ে জীবনের ইতি টানছেন আশরাফের মতো বহু আফগানি।

পাঁচ
প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দেশ তুরস্কের গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি আশরাফের আত্মহত্যার বিষয়টি। আশরাফের কুলখানির প্রায় দুই সপ্তাহ পর আবার গিয়েছিলাম জয়তুনবুরনুতে জালালের বাসায়। মননে আশরাফের স্মৃতি দগদগে থাকায় তখনো বেদনায় মুষড়ে ছিলেন জালালি গ্রুপের সদস্যরা। বহু তাগাদায় মুখ খুললেন জালাল। জানালেন বয়সে ছোট হলেও আশরাফ ছিল তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধু। বলখের এক মাদ্রাসায় একসঙ্গে পড়েছেন তাঁরা। ২০১২ সালের গ্রীষ্মে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন আশরাফের বাবা ও মেজ ভাই। চরমভাবে আহত হন বড় ভাই এবং মা, যখন আশরাফ ছিলেন কিশোর। বলখে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েক মাসের মধ্যেই শীতের কনকনে এক ভোরে দেহত্যাগ করেন আশরাফের বড় ভাই মুহিব্বুল্লাহ।

কিশোর বয়সে কপর্দকশূন্য আশরাফ ভিটেবাড়ি এবং ভেড়াগুলো দুবাই নিবাসী প্রতিবেশীর কাছে বিক্রি করে উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে বলখ থেকে কাবুল নিয়ে গিয়েছিলেন মাকে। শারীরিক ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে আশরাফের ৭১ বছর বয়সী মায়ের দুই পা কেটে ফেলা হয়েছিল; কিন্তু ক্ষত শুকায়নি। আর্থিকভাবে নিঃস্ব আশরাফের পক্ষে অসম্ভব ছিল মায়ের চিকিৎসার ভার বহন। সার্বিক বিবেচনা করে জালালের ছোট বোন জামিলাকে মায়ের দায়িত্ব অর্পণ করে ইস্তাম্বুলের পথ ধরেন আশরাফ। লক্ষ্য ছিল মায়ের চিকিৎসার জন্য কিছু অর্থ আয় এবং কয়েক বছরের মধ্যে ইস্তাম্বুল থেকে ফিরে গিয়ে পছন্দের নারী জামিলাকে জীবনসঙ্গী করে নেবেন। বলখ থেকে ইস্তাম্বুলের পথে ঘাটে ঘাটে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনে বাম পা প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল আশরাফের।

ভয়াবহ নির্যাতনের শেষে গত গ্রীষ্মের শুরুতে ইস্তাম্বুলে পৌঁছান তিনি। শুরু হয় নতুন অনিশ্চয়তা। লাগাতার কারখানার কাজ, নীরস শরণার্থীজীবনের সীমাবদ্ধতা, শারীরিক অসুস্থতা, অতীতের সীমাহীন সন্ত্রাসের ভয়াবহতা আর বলখে রেখে আসা অসুস্থ মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা মানসিকভাবে পরাস্ত করে ফেলেছিল আশরাফকে।

এই পরাজয় আত্মহত্যায় রূপ নেয়, যখন মায়ের মৃত্যুর খবর আশরাফ কাছে পৌঁছায়। দুই পা কেটে ফেলার দরুন সৃষ্ট ক্ষতের অসহ্য ব্যথা কেড়ে নিয়েছে আশরাফের মায়ের জীবন। মায়ের মৃত্যু এবং ছেলের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে পুরো একটি পরিবার। আদতে আশরাফ আত্মহত্যা করেনি; খুন হয়েছেন। ধাপে ধাপে অপরাধীকরণের মাধ্যমে জীবনের আশাগুলোকে ড্রোন দিয়ে হত্যা করে, অনাহার এবং অচিকিৎসায় রেখে খুন করা হয়েছে আশরাফদের। খুনি ব্যক্তি বিশেষ নয় বরং মার্কিনিদের চাপিয়ে দেওয়া ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে অনবরত ‘যুদ্ধ’ নীতি।

ছয়
পুঁজিবাদী পশ্চিমা আধুনিক সন্ত্রাসের স্বীকার হয়ে আশরাফরা যেভাবে জীবনকে বিদায় বলছেন, ঠিক একইভাবে সিরিয়ানরা ডুবে মরছেন ভূমধ্যসাগরে। যেখানে যুদ্ধ সম্ভব হয়নি সেখানে হয় অর্থনৈতিক অবরোধ নতুবা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মার্কিনিরা দায়িত্ব নিয়েছেন মানুষকে ‘সভ্য’ করার। তুরস্ক আর তিউনিসিয়া সাম্প্রতিককালের জ্বলন্ত উদাহরণ। সচেতন পাঠকেরা একমত হবেন যে পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং বিদ্যায়তনগুলোর একটি অংশের লাগাতার প্রচারণা শুধুই তালেবান, নারী শিক্ষা, হেরোইন উৎপাদন, নেশা, ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্র নিয়ে। এসব ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে আফগানদের বোঝার একটি শক্ত প্রবণতা গেঁথে দেওয়া হয়েছে আমাদের চিন্তার মধ্যে। সাম্রাজ্যবাদীদের এই ডিসকোর্সের বাইরে গিয়ে একটি নিরপেক্ষ জমিনের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আফগানিদের বোঝার সংগ্রামে অন্তভুক্ত না হলে অজান্তেই আমরা শত্রু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করব জালাল, আশরাফসহ লাখ লাখ খেটে খাওয়া, মজদুর, অসহায় মানুষদের। বৈধতা পাবে সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এবং নব্য উপনিবেশবাদ। উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজগুলোয় কিংবা আধুনিক জাতি রাষ্ট্রব্যবস্থায় শত্রু-মিত্র কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘু খেলা সব সময় সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিশ্চিত করেছে।

রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক