আন্তর্জাতিক বিচার আদালত: রোহিঙ্গা মামলায় বাংলাদেশও পক্ষ হোক
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকীতে জাতিসংঘ সনদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) মানবতার দাবি পূরণে এক নতুন নজির গড়েছেন। জাতিসংঘের সব সনদ ও চুক্তির ব্যাখ্যা কিংবা সেগুলোর বাধ্যবাধকতা পূরণের প্রশ্ন এবং সদস্যদেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এই আদালতের ওপরেই ন্যস্ত করেছে জাতিসংঘ সনদ। এই পটভূমিতেই গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থতার অভিযোগে গাম্বিয়ার আবেদনে আদালত সর্বসম্মতভাবে বলেছেন যে মিয়ানমারকে অবশ্যই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য আদালত ঠিক কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তা-ও স্পষ্ট করে নির্দেশনা দিয়েছেন।
আইসিজে মিয়ানমারের প্রতি যেসব অন্তর্বর্তী বা সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে রোহিঙ্গারা যে রাতারাতি লাভবান হবে, বিষয়টা এমন নয়। বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া, যা শুরুই করা সম্ভব হয়নি, তা সম্পন্ন হতে কত বছর লাগবে, তা অনুমানে সময়ক্ষেপণ অর্থহীন। তবে মানতেই হবে যে আদালতের এই আদেশে বাংলাদেশের জন্য অনুকূল পরিস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইসিজের রায় বাংলাদেশের জন্য যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা কীভাবে কাজে লাগানো যাবে?
এ জন্য রায়ে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক উপাদানগুলো কী, সেগুলো আগে দেখে নেওয়া যাক। প্রথমত, আদালত বলেছেন যে ‘গণহত্যা সনদের আওতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।’ এই বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি মেলে। তা সত্ত্বেও আরও স্পষ্ট করে আদালত নাগরিকত্বের বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব উদ্ধৃত করে বিষয়টির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের যে অংশটুকু আদালতের আদেশে উদ্ধৃত হয়েছে, তা ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়: মিয়ানমারের স্বাধীনতার আগে থেকে বহু প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সেখানে বসবাস করে আসছেন, সেটি সত্য হলেও ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন তৈরির মাধ্যমে তাঁদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়েছে এবং শেষতক ২০১৫ সালে তাঁদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন পর্যন্ত যে বিষয়টি প্রধান বাধা হয়ে আছে, তা হলো এই নাগরিকত্বের স্বীকৃতি। আদালতের আদেশ এই বাধা অপসারণের পথ খুলে দিয়েছে এবং বাংলাদেশকে এখন এই অতিগুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতিটুকুকেই সম্ভাব্য সমাধানের কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে। এত দিন কূটনৈতিকভাবে তাদের মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত লোকজন (ডিসপ্লেসড পিপল অব মিয়ানমার) হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আদালত তাঁর রায়ে স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে।’ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মিয়ানমার যে দাবি করেছে, তা আদালত নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, গণহত্যা সনদের আলোকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী একটি গোষ্ঠী হিসেবে টিকে থাকার অধিকারকে সুনির্দিষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো প্রমাণ মিয়ানমার আদালতে উপস্থাপন করেনি। ফলে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ যে মিয়ানমারের অসততা ও শঠতার বহিঃপ্রকাশ, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়নের পথে বাধা তৈরি হয় এ রকম যেকোনো পদক্ষেপে তৃতীয় পক্ষের সমর্থনকে নিষ্ক্রিয় (নিউট্রালাইজ) করা এখন অনেকটাই সহজ হবে। কেননা, গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে যারা সহায়তা করবে না, তারা গণহত্যার সহায়ক বা দোসর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। সহজে কেউ ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হবে, এমনটি মনে করার কারণ নেই।
মিয়ানমারের অতীত কার্যক্রমের প্রবণতা থেকে ধারণা করা যায়, তাদের প্রধান কৌশলই হবে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য করা। ‘করছি, করছি’ করে সময়ক্ষেপণ ছাড়াও নানা ধরনের প্রক্রিয়াগত জটিলতার অজুহাত তৈরি করে প্রতিপক্ষের ওপর দোষারোপ এবং নিজেদের দায় এড়ানোর কৌশলটি আমাদের অজানা নয়। গত তিন বছরে ইউএনডিপির তদারকিতে প্রত্যাবাসনের চুক্তি, উদ্বাস্তুদের পরিচয় যাচাই, চীনা মধ্যস্থতায় দুবার বৈঠক অনুষ্ঠানসহ অন্তহীন আলোচনার ফল তাই দাঁড়িয়েছে শূন্য প্রত্যাবাসন। অথচ তারা অসহযোগিতার দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশের ওপর। আদালতেও দেশটি একই ধরনের শঠতাপূর্ণ কৌশল অনুসরণ করবে বলে ধারণা করা তাই খুবই যৌক্তিক। এনএলডির মুখপাত্র মিও নিউন্টের কথাতেও সেই ইঙ্গিতই মেলে। তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, ‘সরকার এই আদেশের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করছে। একটা কাজ এখন আমাদের করতে হবে, তা হচ্ছে আদালতে নিয়মিত রিপোর্ট দেওয়া।’
কূটনৈতিক অসততার বিপরীতে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি বজায় রাখা তাই কোনো কার্যকর ফল দেবে না। গণহত্যার যন্ত্রণাময় স্মৃতিতাড়িত জাতি হিসেবে আমাদের যে নৈতিক অবস্থান প্রয়োজন ছিল, আমরা তা গ্রহণ করতে পারিনি। গণহত্যাকে তার স্বনামে ডাকতে পারিনি। আদালতের আদেশ জারির যৌক্তিকতার প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতি সু হানকিন তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের বিবৃতি এবং ‘টেকসই সমাধান’–এর সন্ধানে মিয়ানমারের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেছেন, এগুলো থেকে সম্ভাব্য গণহত্যার পরিস্থিতি নির্দেশ করে না।
বিচারপতি হানকিন গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে গাম্বিয়ার আইনগত অধিকার প্রশ্নে ভিন্নমত দিয়ে বলেছেন, ‘সনদের কথিত লঙ্ঘনের কারণে সুনির্দিষ্টভাবে এই অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের।’ বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না করে তিনি গণহত্যা সনদের ৯ নম্বর বিধির প্রতি আপত্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন। গণহত্যা সনদের ৯ বিধিতে সনদে অংশগ্রহণকারী যেকোনো পক্ষই এককভাবে আইসিজের শরণাপন্ন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ এই সনদ অনুমোদনে শর্ত দিয়েছিল, আইসিজের শরণাপন্ন হতে উভয় পক্ষের সম্মতি লাগবে। (১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ এই সনদে যুক্ত হয়) তবে, বাংলাদেশ কেন এই শর্ত দিয়েছিল, সে বিষয়ে সরকারি কোনো ব্যাখ্যার কথা জানা যায় না। বিচারপতি হানকিনের মতে, ৯ বিধির প্রতি কোনো দেশের আপত্তি থাকার মানে এই নয় যে এই সনদের আসল উদ্দেশ্যের প্রতি অঙ্গীকারের কারণে সনদের লক্ষ্য পূরণের অভিন্ন স্বার্থে সেই দেশ অংশীদার নয়। এই মন্তব্যে অনুমান করা যায় যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই মামলা করার সুযোগ থাকার প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন।
আইসিজের আদেশের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, বিচারপতিরা সবাই মানছেন যে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সরাসরি ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। গণহত্যা ঘটেছে কি ঘটেনি, তার সত্যাসত্য নির্ধারিত হবে মূল মামলার শুনানিতে। এই পটভূমিতে আদালতে মূল মামলায় বাংলাদেশ পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদনের কথাও ভাবতে পারে। আইসিজের সংবিধির (স্ট্যাটিউট) ৬২ ধারার ১ উপধারা বলছে, কোনো রাষ্ট্র যদি মনে করে, এই মামলার সিদ্ধান্তে তাদের আইনি স্বার্থ আছে, তাহলে তারা মামলায় তাদের কথা শোনার জন্য (ইন্টারভেন) আবেদন করতে পারে।
নমনীয়-শোভনীয় উদার কূটনীতির বদলে এখন একটু কঠোর নীতির কথা ভাবা প্রয়োজন। উদ্বাস্তুদের কাঁটাতারের বেড়ায় বিচ্ছিন্ন করার বদলে মিয়ানমারকে একঘরে করার দিকেই বরং আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। চীন, ভারত, জাপান কিংবা অন্য যেকোনো দেশ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলে তাদের আদালতের আদেশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আদায়ে সহযোগিতার কথা বলতে হবে। অন্য কিছু নয়।
দ্বিতীয় আরেকটি কার্যকর হাতিয়ার আছে, যার উদ্যোগ আসতে হবে নাগরিক সমাজের তরফ থেকে। এটি হচ্ছে মিয়ানমারকে বয়কটের আহ্বান। বর্ণবাদী নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এই বয়কট অভিযান কতটা সফল হয়েছিল, তা সবারই জানা। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যে একই ধরনের বয়কট আন্দোলন শুরু হওয়ায় ইসরায়েল তার মিত্র সরকারগুলোকে এ রকম বয়কট নিষিদ্ধের আইন করতে অনুরোধ জানায়। বৈশ্বিক পরিসরে এ ধরনের বয়কট আন্দোলন মিয়ানমারের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও অর্থনীতিকে প্রচণ্ড চাপের মুখে ফেলবে। এই রায় বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি মিয়ানমারকে যে আবারও সেই সামরিক শাসনামলের মতো একঘরে করে ফেলবে, সেটা বোঝানোর জন্যই এমন আন্দোলন প্রয়োজন। বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিদ্যমান কাঠামো ও ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের এটি একটি সুযোগ। সেটিকে কাজে লাগাতে হবে।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক