আনিসুজ্জামান: বাঙালির বাতিঘর
চলে গেলেন বাঙালি মনীষার উজ্জ্বল প্রতিনিধি, আমাদের জাতির শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান। কেবল শিক্ষক আর গবেষক হিসেবেই নয়, বহু উজ্জ্বল কৃতী ও কীর্তিতে অনন্য হয়ে ওঠা একটি নাম—আনিসুজ্জামান। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের যে কজন মানুষ নিজেদের ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বিশ্ব-ভূগোলে, আনিসুজ্জামান তাঁদের অন্যতম। লেখক, গবেষক, শিক্ষাচিন্তক, সংস্কৃতিসাধক, মুক্তিসংগ্রামী, মানবাধিকার সংগঠক, সর্বোপরি জাতির বিবেক—কতভাবেই তো আনিস স্যার নিজেকে মেলে ধরেছেন জাতির সামনে। একজন সংবেদনশীল প্রগতিপন্থী মানুষ হিসেবে তাঁর তুল্য কজন মানুষ আছেন আমাদের? কত বাঙালির নামই তো আছে আনিসুজ্জামান—তবু কেন জানি আনিসুজ্জামান নামটা শুনলেই মনে জাগে সমাজসচেতন এক বুদ্ধিজীবী, দীপ্ত এক মনীষার অবয়ব। সহজ সাবলীল স্বাভাবিকভাবে চলতে চলতে একজন মানুষ কী করে যে এমন অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন, তাঁর সান্নিধ্যে না গেলে সে কথা অনুধাবন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
বাঙালি জাতির একটা পর্বের ইতিহাসের সঙ্গে আনিসুজ্জামানের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রটির কথা আজ মনে পড়ছে। কী অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সেদিনের কিশোর আনিসুজ্জামান মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে সে গ্রন্থের জন্য লিখেছিলেন উৎসর্গ বয়ান। পনেরো বছরের এক কিশোর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন নিজের হস্তাক্ষর ছাপতে দিয়ে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রেক্ষাপট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অবগত করানোর জন্য তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। আনিসুজ্জামানের ‘আমার একাত্তর’ পাঠ করলেই জানা যাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর গভীর সংশ্লিষ্টতার কথা। বাংলাদেশের সংবিধান বাংলায় অনুবাদ করে আনিসুজ্জামান পালন করেছেন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের প্রতীকী বিচারকার্যে বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণ করেও তিনি পালন করেছেন সামাজিক দায়বদ্ধতা; এই দায়বদ্ধতা থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে তিনি হাজির হন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। যখনই জাতীয়ভাবে গভীর কোনো সংকটে আমরা পড়েছি, আনিসুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গে জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, কলম হাতে পত্রিকার পাতায় হাজির হয়েছেন সাহসী ভূমিকায়।
মুক্তবুদ্ধি ও মাঙ্গলিক চেতনা দ্বারা আজীবন পরিচালিত হয়েছেন আনিসুজ্জামান। তাঁর সব কর্মের পশ্চাতেই আছে অপরের জন্য মঙ্গলবাসনা। নিজের স্বার্থকে অবলীলায় তিনি সবার স্বার্থের কাছে তুচ্ছ করে তুলতে পারেন, অন্যের মঙ্গলকে ভাবতে পারেন নিজের মঙ্গল হিসেবে। এমন সজ্জন মানুষ, সুরুচির অধিকারী এমন পণ্ডিত আমাদের সমাজ কেন, যেকোনো সমাজেই বিরল। মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতে পারতেন সাবলীলভাবে, তাঁর পাণ্ডিত্য সে ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অদ্ভুত এক নির্মোহ দিয়ে নিজেকে ঊহ্য রাখতে পারতেন আনিসুজ্জামান। তাঁর আত্মজীবনী পাঠ করলেই বোঝা যায় দেশ-জীবনই হয়ে ওঠে তাঁর আত্মজীবন—নিজে সেখানে কেবলই কথকমাত্র। সন্দেহ নেই, আমাদের আমিময় সমাজে এ-ও এক বিরল গুণ।
গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামানের খ্যাতি ও সিদ্ধি শিখরস্পর্শী। পঁচিশ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ‘মুসলিমমানস ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক পিএইচ-ডি অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি রেখেছেন অনন্য মেধার স্বাক্ষর। পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের গবেষণা বাংলা গদ্যের ইতিহাস রচনায় সঞ্চার করেছে অনেক নতুন মাত্রা। পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে তাঁর গবেষণা গবেষক হিসেবে তাঁর নিষ্ঠা, প্রযত্ন ও দূরদৃষ্টির পরিচয়বহ। বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক সম্পর্কে আনিসুজ্জামান গবেষণা করেছেন, গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুনীর চৌধুরী, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, অজিত গুহ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ লেখক সম্পর্কে তাঁর গবেষণা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে, Anowar Abdel Malek-এর সঙ্গে যুগ্ম লেখক হিসেবে বই লিখেছেন তিনি, ইউনেসকোর অনুরোধে বিশ্বসংস্কৃতি সম্পর্কে গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তিনি। অনুবাদক হিসেবেও আনিসুজ্জামানের অবদানের কথা স্মরণযোগ্য। বাংলা ভাষায় আত্মজীবনীর ধারায় আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’ এক বিশিষ্ট সংযোজন। এ গ্রন্থদ্বয়ে তাঁর নিজের কথা যত না উঠে এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ফুটে উঠেছে পরিবর্তমান সময় ও সমাজ এবং পরিশার্শ্বের ছবি। সাহিত্য–সম্পাদনার ক্ষেত্রেও আনিসুজ্জামানের অবদানের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। অনেক লেখকের রচনা তিনি সম্পাদনা করেছেন, সম্পাদনা করেছেন দুষ্প্রাপ্য অনেক বই। অনেক স্মারক গ্রন্থ বা সংবর্ধনা গ্রন্থের সম্পাদক তিনি তাঁর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের দুটি খণ্ড। তবে সম্পাদনার ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গৌরবজনক কাজ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক গ্রন্থ। রবীন্দ্রবর্জনের সেই স্বৈরবৃত্তকালে ‘রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশ ছিল রীতিমতো এক বিদ্রোহ। সম্পাদনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অধুনা একমাত্র নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’–এর কথাও এখানে উল্লখ করা যায়। ওই পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের তিনি ছিলেন সভাপতি।
ডক্টর আনিসুজ্জামান কেবল সাহিত্য–গবেষক নন, তাঁর গবেষণায় সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি—সবকিছুই একাকার হয়ে গেছে। নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠ এবং সুমিত ভাষার জন্য তাঁর যেকোনো গ্রন্থই সুখপাঠ্য এবং জ্ঞানোদ্দীপক। তাঁর গ্রন্থ পাঠ করলে জ্ঞানের উত্তাপ পাওয়া যায়, শুধরে যায় পাঠকের ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার প্রান্তগুলো।
সামাজিক মনস্বিতা বলতে যা বোঝায়, ডক্টর আনিসুজ্জামান ছিলেন তার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এমন মনস্বিতারুদ্ধ মানুষ আমাদের সমাজে আর কবে আসবে কে জানে? তিনি ছিলেন আমাদের দুর্দিনের বাতিঘর। আমাদের জাতির শিক্ষক আনিস স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, জানাই অন্তরমথিত ভালোবাসা।
বিশ্বজিৎ ঘোষ: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য