২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আদালতের সুপারিশ সরকার আমলে নেবে?

সহযোদ্ধাদের কাঁধে সেনা কর্মকর্তার লাশ
সহযোদ্ধাদের কাঁধে সেনা কর্মকর্তার লাশ

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত পিলখানা ট্র্যাজেডির বেদনা ও বিষাদ আমাদের আরও বহুদিন তাড়িত করবে। একসঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার দ্বিতীয় নজির দেশের ইতিহাসে নেই। এটি ছিল পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড। কথিত বিদ্রোহের নামে তৎকালীন বিডিআর জওয়ানেরা কেবল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি; নারীদের ধর্ষণ করেছেন, চালিয়েছেন ধ্বংসযজ্ঞ।

পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর সিপাহি বিদ্রোহের নামেও এ রকম আরেকটি হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল, যার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফসহ ডজনখানেক সেনা কর্মকর্তা। ৪২ বছর পরও সেই হত্যার তদন্ত বা বিচার হয়নি।

কিছুটা বিলম্বে হলেও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারে হাইকোর্টের রায় পাওয়া গেছে। আদালত ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে আরও একটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে—আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়। বিচারে কতজনের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হলো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো অপরাধের বিচার এবং তা হয়েছে প্রচলিত আইনেই।

বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে কারাগারে নাসির উদ্দিন মারা যান। হাইকোর্টের রায়ে তোরাব আলী খালাস পেয়েছেন।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ রায়ের পাঁচ দফা পর্যবেক্ষণে বলেছেন: ১. বিডিআরের বিদ্রোহীরা পরস্পরের যোগসাজশে এবং অভিন্ন লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল বিডিআরকে (বর্তমান বিজিবি) সেনা কর্মকর্তামুক্ত করা এবং বাহিনীতে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ২. কোনো উসকানি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, হতাশা বা ক্ষোভই পিলখানার ৫৭ জন চৌকস ও সম্ভাবনাময় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ন্যায্যতা দিতে পারে না। ৩. অপরাধের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। এই হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে জাতি কিছু প্রতিশ্রুতিশীল, উজ্জ্বল, সম্মানিত ও প্রতিভাবান সেনা কর্মকর্তাকে হারিয়েছে। এই ক্ষতি পূরণ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। বিডিআরের অবাধ্য বিদ্রোহীরা যে মাত্রায় নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নেবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। ৪. ঘটনা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এটাই বেরিয়ে আসে যে অভ্যন্তরীণ কিংবা বাইরের শক্তি নবগঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ৫. এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য কোনো মহলের নীলনকশায় দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা এবং গণতন্ত্রের ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আদালত সাত দফা সুপারিশ তুলে ধরেছেন যথাক্রমে: ১. এটা আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা (পায়াস উইশ), অপারেশন ডাল-ভাতের মতো এমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া উচিত নয়, যা বিজিবির সদস্যদের গৌরব ও আত্মসম্মানে আঘাত হানে। এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে এ ধরনের কর্মসূচি তাদের সৈনিকমূলক আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২. অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যকার পেশাদারি সম্পর্ক বিজিবির আইন মোতাবেক হতে হবে। ৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিজিবি কর্তৃপক্ষকে বিজিবি সদস্যদের যেকোনো সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সমাধান দিতে হবে। ৪. বিজিবির সদস্য ও কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো কোনো দুঃখ-দুর্দশা থাকলে বিজিবি কর্তৃপক্ষকে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। ৫. বিজিবির কোনো সদস্যের ভ্রমণ ভাতা ও দৈনন্দিন ভাতা এখনো বাকি থাকলে তা দ্রুত মিটিয়ে দিতে হবে। ৬. বিজিবি কর্তৃপক্ষকে তাদের অর্জিত ছুটি এবং এ-সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ৭. বিডিআরের রাইফেল সিকিউরিটি ইউনিট কেন বিডিআর হত্যাযজ্ঞের আগে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন এবং প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বিজিবি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন আদালত।

যেকোনো রায়ের দুটি অংশ থাকে। একটি আদেশ। এতে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে রায়ের এই পর্বের কাজ শেষ। কিন্তু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ হলো যথাক্রমে অপরাধের প্রেক্ষাপট ও কার্যকরণ ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ যাতে সংঘটিত না হতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।

সব রায়েই কমবেশি পর্যবেক্ষণ থাকে। কিন্তু আলোচ্য রায়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে এর পর্যবেক্ষণই হয়েছে ১ হাজার পৃষ্ঠার। পূর্ণাঙ্গ রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার। কোনো একক ঘটনায় যেমন এত বেশিসংখ্যক মানুষকে জীবন দিতে হয়নি; তেমনি এত বেশিসংখ্যক মানুষের শাস্তিও হয়নি। বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় ১০ হাজারের বেশি জওয়ান শাস্তি পেয়েছেন। 

হাইকোর্ট দুটি বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, বিডিআরের সদস্যরা কঠোর ভাষায় লিফলেট বিলি করার পরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রতিকারের কিংবা তঁাদের ক্ষোভ প্রশমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। দ্বিতীয়ত, হত্যাকাণ্ডের আগে বিডিআরের সদস্যরা সংগঠিত হয়েছেন, নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাজনীতিকসহ বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা এ-সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি।

আমরা মনে করি, এই ব্যর্থতা কেবল বিডিআরের গোয়েন্দাদের নয়। এই ব্যর্থতা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বা বিভাগেরই। গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণেই পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হয়েছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে জীবন দিতে হয়েছে। 

এ কথা বলার উদ্দেশ্য নয় যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই করেনি বা করছে না। নিশ্চয়ই তারা অনেক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল ছিন্ন করেছে। তাদের কারণেই জঙ্গি আস্তানাগুলোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সব দেশেই রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম হতে হয় নিশ্ছিদ্র ও নিরবচ্ছিন্ন, যেখানে ব্যর্থ হওয়া কিংবা সামান্যতম দুর্বলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। কেননা এর সঙ্গে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত রাষ্ট্রের অস্তিত্বও।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যেভাবে বিডিআরের সদস্যরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, যেভাবে তাঁরা সারা দেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাতে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সে সময়ে মিয়ানমার কক্সবাজারে মিগ-২৯ নামিয়েছে বলে একটি মহল প্রচার করেছিল, যা মিয়ানমারের সঙ্গে একটি যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারত।

এখন প্রশ্ন হলো পিলখানা হত্যা মামলার ওপর আদালত যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেসব সুপারিশ করেছেন, সেগুলো সরকার আমলে নেবে কি না। যেকোনো শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনী পরিচালনা করতে হয় সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব এবং সদস্যদের শৃঙ্খলা, দক্ষতা ও পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে। সেখানে দ্বন্দ্ব-বিবাদকে সামান্যতম প্রশ্রয় উচিত নয়।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনিস-উজ-জামান খানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে (পৃষ্ঠা-১৭) সরাসরি বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত অবস্থাগুলো জাতীয় দুর্যোগকালে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অপেশাদারি ও অমার্জনীয় ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে।’ এবং একই সঙ্গে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ‘সকল গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের কার্যপদ্ধতি ঢেলে সাজানোর জন্য’ পরামর্শ দেওয়া হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে প্রধানমন্ত্রীর পিলখানা সফর উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে এসএসএফের কাছে পাঠানো হয়।’

এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্ণিত কর্মসূচিতে যোগদানের ক্ষেত্রে ভিআইপির ব্যক্তি নিরাপত্তায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুমকিসংক্রান্ত কোনো তথ্য আপাতত নেই।’ তবে এতে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের নাশকতামূলক তত্পরতার আশঙ্কা করা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থা যেখানে জঙ্গি সংগঠনের নাশকতার আশঙ্কা ছাড়া কিছু অনুমান করতে পারেনি, সেখানেই ঘটল বিদ্রোহ ও নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড।

আনিস-উজ-জামান কমিটির সুপারিশে এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি ‘জাতীয় সংকট মোকাবিলা কমিটি’ গঠনের পাশাপাশি বিডিআর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র যথাসময়ে উদ্ঘাটনে ব্যর্থতা এবং বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

আনিস–উজ–জামান কমিটি তদন্তকাজে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পুরোপুরি সহযোগিতা পাননি বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। সরকারি কমিটির পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর কোর্ট অব ইনকোয়ারিও (তদন্ত আদালত) একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল, যাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

দুই কমিটির সুপারিশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা জানি না। তবে আট বছর পর উচ্চ আদালতের রায়েও প্রায় একই ধরনের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ এসেছে। আদালত পিলখানা হত্যাযজ্ঞের আগে গোয়েন্দারা কেন তথ্য িদতে ব্যর্থ হলেন, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। প্রত্যাশা থাকবে, সরকার সে ধরনের কমিটি করবে এবং প্রকৃত তথ্য দেশবাসীকে জানাবে।  

অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা গেছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে। কেউ ষড়যন্ত্র বা অপরাধ করলে অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা দলকে অপরাধী সাব্যস্ত করলে কেবল বৈরিতাই বাড়ে না, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব কম ক্ষেত্রেই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে (গত সাতাশ বছরে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যর্পণই একমাত্র ব্যতিক্রম)। অন্যান্য ক্ষেত্রে যা-ই হোক না কেন, যার সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জড়িত, সেসব বিষয়ে দায়িত্বে অবহেলা করলে কিংবা একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে দেশ কোথায় যাবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব একবার ভেবে দেখেছেন কি? 

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।