২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আত্মহত্যার ‘মহামারি’ ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত আমরা

আত্মহত্যা ঠেকাতে হলে পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সমমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি

খুব ভোরে চিলের ডাক, শামুকের ডিম, জলে ভাসা হিজল, বেলি ফুলের মালা, শূন্য আর অনন্তের ধারণা, গীতা ঘটকের কণ্ঠে ‘ও চাঁদ’, চা দিয়ে বাকরখানি, নিজের জমানো টাকা বাবাকে দেওয়া—এ বিষয়গুলো যে কারও কাছে সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকার মঞ্চে সৈয়দ জামিল আহমেদের নাটক বিস্ময়কর সবকিছু যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে এটা বিস্ময়ের কিছু নয়। এগুলোর একেকটি একেকজন মানুষের জীবনের পাওয়া বিস্ময়। নাটকটিতে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন নাট্যকার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষ করে করোনার দিনগুলোয় আত্মহত্যার আরেক মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পড়াশোনা শেষ করা বেকার, কাজ হারানো ব্যবসায়ী, দিনমজুর, সন্তানের মুখে খাবার তুলে না দিতে পারা মা-বাবা থেকে শুরু করে অল্পবয়সী শিক্ষার্থী—প্রায় সব বয়স ও শ্রেণির মানুষ আত্মহত্যার দীর্ঘ মিছিলে যুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, করোনাকালে দেশে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, আত্মহত্যা বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আশঙ্কাজনক তথ্য আছে—মোট আত্মহত্যাকারীর ৮৩ শতাংশেরই বয়স ৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

শিশু-কিশোর ও তরুণেরা সমাজের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল অংশ। তাদের অনেকে এখনো জীবনটাকে শুরুই করতে পারেনি, এর আগেই নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করে নিতে হচ্ছে। সম্প্রতি জামালপুর ও ময়মনসিংহের দুটি আত্মহত্যার ঘটনা আলোচিত হয়েছে। দুজনেই কিশোরী, দশম শ্রেণিতে পড়ত। মেলান্দহের কিশোরী আত্মহত্যার আগে চিরকুট লিখে রেখে জানায়, সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তার ধারণা হয়েছিল, সে বেঁচে থাকলে মা-বাবার মানসম্মান নষ্ট হবে। ময়মনসিংহের কিশোরী আত্মহত্যার আগে তার ফেসবুকে ইংরেজি ও বাংলায় বড় একটি পোস্ট শেয়ার করে। তাতে সে তার পরিবারকে আত্মহত্যা করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। লিখেছে, তার মরার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েছে। পরিবারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে পারেনি সে। যদিও পরিবার জানিয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালের বিষণ্ণতায় ভুগছিল ওই কিশোরী। তাঁর চিকিৎসা চলছিল।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, মায়াকোভস্কি, মেরিলিন মনরোর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করেছেন। সমাজের চোখে সেলিব্রিটি যাঁরা, তাঁদের আত্মহত্যার খবর আরও অনেকের আত্মহত্যার কারণ হয়ে ওঠে। মেরিলিন মনরো যে মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা বেড়ে গিয়েছিল ১৫ শতাংশ।

নতুন প্রজন্মের একাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবারগুলো এ ধরনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঠেকাতে কতটুকু প্রস্তুত? গণমাধ্যমগুলোও আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা দায়িত্বশীল? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করছে?

আমাদের সমাজ একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্কই এখন সবকিছুর কেন্দ্রে চলে এসেছে। যৌথ পরিবার ভাঙা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এখন বাড়ছে পরিবারহীন একক মানুষের সংখ্যা। ঘর, অফিস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাইরে ব্যক্তির জনপরিসর সীমিত হয়েছে। এ কারণে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ এখন সামাজিক নিয়তি। মানুষে মানুষে জৈবিক সম্পর্কের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল সম্পর্ক। বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়ার বদলে ব্যক্তির মধ্যে একটা অবাস্তব ঘোরের জগৎ তৈরি হচ্ছে।

হতাশা, আকাশসম প্রত্যাশা, সীমাহীন চাপ, একাকিত্ব, নিজেকে দায়ী ভাবা, আশাহীনতা—এমন অনেক কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু সুস্থতা বলতে শারীরিক ও মানসিক দুই স্বাস্থ্যকেই বোঝায়।

আরও পড়ুন

ফিরে আসি জামিল আহমেদের বিস্ময়কর সবকিছু নাটকে। বিষণ্নতাক্লিষ্ট এক মায়ের একমাত্র সন্তানের জীবনের নানা পর্যায়ের কাহিনি সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। শুরুতেই সাত বছরের সেই সন্তানের মা তার নিজের প্রাণনাশের চেষ্টা করে। মাকে বেঁচে থাকার মানে জোগান দেওয়ার অদম্য বাসনা থেকে একটি তালিকা তৈরি শুরু করে সাত বছরের মেয়েটি। তালিকায় মানবজীবনের বিস্ময়কর সবকিছুর নাম লিপিবদ্ধ করে মাকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছা জাগে তার মনে। ছোট্ট সেই মেয়ে বড় হতে থাকে। তার প্রেম, পরিণয়, বিবাহবিচ্ছেদ এবং মায়ের মৃত্যু হয়। সব হারিয়ে জীবনের অর্থও একসময় তার কাছে নিঃশেষ হয়ে যায়। আত্মহত্যার প্রশ্নটি তার সামনে এসে উপস্থিত হয়। শেষ পর্যন্ত সে উঠে দাঁড়ায় অসামান্য এক প্রচেষ্টায়। তার উপলব্ধি হয়, যত দিন বেঁচে থাকা, তত দিন যেকোনো কিছু করা সম্ভব।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, মায়াকোভস্কি, মেরিলিন মনরোর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করেছেন। সমাজের চোখে সেলিব্রিটি যাঁরা, তাঁদের আত্মহত্যার খবর আরও অনেকের আত্মহত্যার কারণ হয়ে ওঠে। মেরিলিন মনরো যে মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন, সেই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা বেড়ে গিয়েছিল ১৫ শতাংশ। আত্মহত্যার খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের জন্য গাইডলাইন করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যাচেষ্টার বিশদ বর্ণনা দেওয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের খবর প্রকাশ না করা কিংবা সংশ্লিষ্ট ছবি ও ভিডিও ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

আত্মহত্যা ঠেকাতে হলে পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সমমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে, তাদের প্রতি মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, বন্ধু, সহকর্মীদের নজর দিতে হবে। প্যারেন্টিংয়ের নামে শিশুদের ওপর অযথা চাপ তৈরি করে তাদের জীবন বিষিয়ে দেওয়ার চর্চা থেকে অভিভাবকদের বেরিয়ে আসতেই হবে। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ যারা করে, অপমান ও দায়টা আসলে সেই ধর্ষক ও নিপীড়কের, সমাজে সেই বোঝাপড়া তৈরি করাও জরুরি।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক