সংবিধান বলছে, এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। দেশটা ‘ছোটদের বড়দের সকলের, গরিবের নিঃস্বের ফকিরের’—সবার; সবাই জনগণ। সুতরাং রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ি অথবা চোখ ছানাবড়া করার মতো বিলাসবহুল বাড়ি, জেল্লাদার ফ্ল্যাট বা চাকচিক্যময় শপিং মলের মালিকের সঙ্গে বস্তিবাসীর বা ফুটপাতের খুদে ব্যবসায়ী কিংবা ভ্যানে সবজি বিক্রি করা মানুষটির মধ্যে একটা ‘যোগ’ আছে।
একইভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার কলকারখানা বা প্রায় আস্ত শহরসম আবাসন প্রকল্পের কর্ণধার কিংবা দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রান্তিক চাষা-মুটে-মজুরেরও রয়েছে দেশের ‘মালিকানায়’ হিস্যা এবং স্বভাবতই তাদের মধ্যকার ‘যোগ’ও অস্বীকারের উপায় নেই। তবে তেল ও জলের মহিমা বাস্তবে রূপদানকারী এ দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বিতীয় আরেকটি ‘যোগ’ও বিদ্যমান, যা সংবিধানে বিবৃত নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিস্ফুট নয়, জাতিগত আকাঙ্ক্ষার পরিচায়কও নয়, তবু তা-ই আজ সবচেয়ে জাগরূক, সবচেয়ে কার্যকর, সবচেয়ে বাস্তব!
স্বাধীনতার বয়স যখন অর্ধশতকের ঘর পেরোল, তখন পরাধীনতার আলাপ বাহুল্য ঠেকতে পারে অনেকের কাছে, কিন্তু শহর-মফস্বলের সব মানুষ স্বাধীনতার সুফল সমানভাবে পাচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন ততটাই জরুরি, যতটা জরুরি গাছের সঙ্গে পানির সম্পর্ক। চারা লাগানোর প্রথম শর্তই নিয়মিত পরিচর্যার বন্দোবস্ত পাকা রাখা। তা না হলে ফলের স্বপ্ন স্বপ্নই থাকবে, কাঠ বেচে পয়সা উশুলও সম্ভব হওয়ার নয়।
বাঙালি সম্পর্কে মেকলে সাহেবের (টমাস বেবিংটন মেকলে) মূল্যায়নকে একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট বলেন অনেকেই, কিন্তু তাঁরাও জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। কেননা, তাঁরা চোখ মেলে বাস্তব দেখে ‘সত্য’ স্বীকারের সাহস রাখেন না। পরিসংখ্যানে দেশের উন্নতি-অগ্রগতির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপেন, দেশের বুকে ভুলেও ‘স্টেথোস্কোপ’ রাখেন না তাঁরা। মানবশরীরের হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখতে বহু ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, এমনকি হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করার মতো ব্যবস্থাও বহাল, কিন্তু দেশের ‘হৃদয়’ ভালো থাকে কেবল সুশাসনে, তার রক্ত চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে পারে কেবল গণতন্ত্র। এ কথার কতটা কম বাস্তব রূপ দৃশ্যমান কিংবা সুশাসন-গণতন্ত্রের প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগর হালহকিকত বেশ কিছু সূচক-জরিপ-গবেষণার বরাত দিয়ে তুলে ধরার একটা কোশেশ দেখা যায় বটে, কিন্তু নিজেদের দেখাশোনায়, জীবনযাপনে, সর্বোপরি অভিজ্ঞতার নির্যাসটা (আত্মোপলব্ধি?) কেমন?
এর ডাকনাম নাকি ‘উপরি আয়’, আদতে তা ভিক্ষাবৃত্তির ‘বঙ্গীয় সংস্করণ’! দান-খয়রাত করেন মানুষ ইচ্ছায়, এসব ক্ষেত্রে তাঁদের ‘জিম্মি’ করা হয়। এ কারণেই কি ‘মানুষ (পড়ুন বাঙালি) মাগনা আলকাতরাও খায়’ কথাটি আমাদের সমাজ এতটা প্রচলিত? সুতরাং নিয়মের ব্যত্যয় ফুটপাত থেকে দপ্তরের অন্দর তক বিস্তৃত, প্রান্তিক জনপদ থেকে রাজধানীর কেন্দ্র তক ‘বিষের বেসাতি’।
এই নিবন্ধকার দিন বিশেক আগে রাজধানীর জিগাতলায় ফুটপাতের এক দোকানির কাছ থেকে কলা কিনছিলেন। তখন পরপর দুই ব্যক্তি এসে ২০ ও ৩০ টাকা নিয়ে গেলেন। কৌতূহল বুঝতে পেরে দোকানি বলেন, ‘একটা এলাকার “রাজনৈতিক ভাইবেরাদরদের” টাকা, অন্যটা ফাঁড়ির। এর বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাদের জন্য সপ্তাহে দিতে হয় ১০০ টাকা।’ অর্থাৎ সব মিলিয়ে এই খুদে দোকানিকে মাসে তাঁর দিকে ‘পাতা হাতে’ তুলে দিতে হয় ১ হাজার ৯০০ টাকা। জিগাতলার শুধু এই ব্যক্তি নন, রাজধানীজুড়ে প্রতিদিন মোটাদাগে তিন বেলা পেটের খাবার জোটাতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে ফুটপাতে বসা খুদে ব্যবসায়ী, ভ্যানে করে সবজিসহ নানা পণ্য বিক্রেতাদের দিকে ধেয়ে আসে এমন বহু হাত। এভাবে প্রতিদিন কত শত কোটি টাকা তোলা হয় এবং কত স্তরে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়, তার কিছু খণ্ডচিত্র নানান সময় পত্রপত্রিকায় উঠে আসে, টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়, তবে অবস্থার ইতরবিশেষ হয় না। রাজধানীর এই ‘বাস্তবতা’ জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকার হাটবাজার তক জেঁকে বসেছে।
প্রতিদিন সড়কে কী পরিমাণ টাকা তোলা হয়, তার হিসাব কষা কঠিন, কিন্তু তা কোনোভাবেই শত কোটি টাকার কম নয়। এমনকি টাকার জন্য ‘নোংরা’ ঘাঁটতেও পিছপা নন হাত পাতনেওয়ালারা! ঢাকায় বাসাবাড়ি থেকে ময়লা নেওয়ার জন্য মাসে ফ্ল্যাট বা পরিবারপ্রতি ৩০ টাকা নেওয়ার কথা; এলাকাভেদে নেওয়া হয় ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা। এভাবে প্রতিটি খাতে, প্রতিটি ক্ষেত্রে হাত পেতে টাকা তোলা হচ্ছে, প্রতিদিন, দিনদুপুরে। কেউ একজন নতুন বাড়ি করবেন বা নতুন ব্যবসা শুরু করবেন, তাঁকে এলাকার প্রভাবশালীকে, কোনো গ্রুপ বা গ্যাংকে ‘খুশি’ না করার উপায় নেই। এই টাকাকে ‘চাঁদা’, ‘মাসোহারা’, ‘তোলা’, ‘বখরা’—যা খুশি নামে ডাকা হোক, কিংবা ভাইদের মিষ্টিমুখ করানো বা সন্তুষ্ট করা, যতভাবেই জায়েজের চেষ্টা হোক, শেষ পর্যন্ত তা ‘হাত পেতে’ নেওয়া টাকা।
কারা নিচ্ছেন এ টাকা, কোন পর্যায় পর্যন্ত কাদের পকেটে ধাপে ধাপে ঢুকছে, তা শহরের ইট-পাথর থেকে শুরু করে গ্রামীণ হাওয়া-বাতাসেরও অজানা নয়! শুরুতে তাঁরা বাহারি মোটরসাইকেলে বলিউডি সিনেমার নায়কের বেশে চক্কর কাটেন, কিছু সময়ের মধ্যে চার চাকার মালিক বনে যান। একে একে ফ্ল্যাট, বাড়ি, জায়গা-জমি, কারখানা…বাড়তেই থাকে সম্পদের তালিকা। এর সপক্ষে নতুন-পুরোনো, টাটকা-বাসি উদাহরণ ভূরি ভূরি।
যে কারখানা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ন্যায্য মজুরি দেন না, তিনিও তো শ্রমিকের কাছ থেকে ‘হাত পেতেই’ টাকা নিচ্ছেন। শ্রমিক-কর্মীরা নিরুপায়, কিন্তু যদি ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পের মতো মালিক এক দিনের জন্যও শ্রমিক হতেন, তাহলে দেখতে পেতেন, আমাদের গর্বের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত থেকে শুরু করে গ্রাম-মফস্বলের একটা ইটভাটা, স মিল অথবা ধানের চাতালের একজন শ্রমিক কত টাকা কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন!
এভাবে হাত কেবল রাস্তাঘাটে, বাজারহাটে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা এবাড়ি-ওবাসায় পাতা হয় না, অফিস-কাছারি, হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রও হাত পাতার ‘আদর্শস্থলে’ পরিণত। কোট-প্যান্ট পরা সরকারি চাকুরেটিও আপনাকে আপনার প্রাপ্য সেবা-পরিষেবা দেওয়ার আগে আপনার দিকে ‘হাত পাতবেন’। তাঁরা তো ‘কিছু পেয়ে থাকেন’। ‘অফিস খরচ’, ‘চা-নাশতার টাকা’ বা সরাসরি ‘ঘুষ’—যে নামেই ডাকুন, না দিলে সেবা নৈবচ নৈবচ। রেলস্টেশনে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে একাধিকবার ১০ থেকে ২০ টাকা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই নিবন্ধকারের। অজুহাত হিসেবে বলা হয়, খুচরা টাকা নেই। পরে টিকিট কাউন্টারের পাশে কিছু সময় অপেক্ষা করে দেখা যায়, যাঁরাই ৫০০ বা হাজার টাকার নোট দিচ্ছেন, তাঁরাই ‘খুচরার অভাবে’ ১০ থেকে ২০ টাকা কম পাচ্ছেন।
এর ডাকনাম নাকি ‘উপরি আয়’, আদতে তা ভিক্ষাবৃত্তির ‘বঙ্গীয় সংস্করণ’! দান-খয়রাত করেন মানুষ ইচ্ছায়, এসব ক্ষেত্রে তাঁদের ‘জিম্মি’ করা হয়। এ কারণেই কি ‘মানুষ (পড়ুন বাঙালি) মাগনা আলকাতরাও খায়’ কথাটি আমাদের সমাজ এতটা প্রচলিত? সুতরাং নিয়মের ব্যত্যয় ফুটপাত থেকে দপ্তরের অন্দর তক বিস্তৃত, প্রান্তিক জনপদ থেকে রাজধানীর কেন্দ্র তক ‘বিষের বেছাতি’। সুতরাং নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ অঢেল সম্পদশালী, রাজনীতির দাপুটে কারবারি, দোর্দণ্ড প্রভাবশালীর সঙ্গে চাষা-মুটে-মজুরের ‘দ্বিতীয় যোগ’টি স্পষ্ট। তাই দুর্নীতির সূচকে দেশের অবস্থান ওপরের দিকে থাকায় ‘অস্বাভাবিকতার’ কিছু নেই! একবার ভাবুন তো, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’—কবির এই প্রার্থনা মঞ্জুর হলে আমাদের কী দশা হতে পারে!
এটুকু বলে থেমে যেতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু নৈতিকতার এহেন স্খলন, হেলায় আত্মমর্যাদার এমন বিসর্জন, মানবিক মূল্যবোধের এই অতল অবনমনের কী হবে? নীরদ সি চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। কিন্তু আমরা যে ‘আত্মঘাত’কে এত দিনে রীতিমতো ‘সংস্কৃতি’তে রূপান্তর করে ফেলেছি। ত্রাণসামগ্রীও নয়ছয়ের মচ্ছব হয় এ দেশে! একজন দুস্থকে তাঁর ভাতা বা খাদ্যসহায়তার কার্ড পেতেও দিতে হয় টাকা এবং জনপ্রতিনিধিরা তা অম্লানবদনে ‘হাত পেতে’ নেন! এমন আত্মমর্যাদাহীন জাতির মাথাপিছু আয়ের হিসাব কষার আগে দরকার মাথার ভেতরের ‘পচন’ দেখা!
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]