২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আজ খোয়াজ খিজিরের চশমাটি আমি চাই

১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর সূচনা সংখ্যায় প্রথম আলোকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এই লেখা লিখেছিলেন সদ্য প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাগুলো নিয়ে লেখাটি লিখেছিলেন তিনি, যা আজও প্রাসঙ্গিক। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১৯৩৪–২০২২)

প্রথম আলোর জন্য আমার প্রথম লেখা লিখতে বসে প্রাচীনকালের এক মহাপুরুষ হজরত খোয়াজ খিজিরের একটি কাহিনি মনে পড়ে গেল। পয়গম্বর মুসা (আ.) একদিন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘প্রভু, পৃথিবীতে আমি একজন খাঁটি মানুষের সন্ধান চাই।’ মুসা (আ.) পবিত্র প্রথম আলো (আল্লাহর নূর) প্রথম দর্শন করেন সিনাই পাহাড়ে। আল্লাহ তাঁকে বললেন, তুমি সিনাই পাহাড় থেকে নেমে শহরে যাও। সেখানে দেখবে, রাস্তার পাশে বসে চশমা চোখে এক মুচি জুতা সেলাই করছেন। তাঁর নাম খোয়াজ খিজির। তাঁর কাছে তুমি প্রকৃত মানুষের সন্ধান পাবে।

আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে মুসা (আ.) খুশিমনে শহরে গেলেন এবং দেখলেন, সত্যি সত্যি রাস্তার পাশে বসে এক মুচি চশমা চোখে জুতা সেলাই করছেন। মুসা (আ.) তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আপনিই তো খোয়াজ খিজির। আমি আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে আপনার কাছে এসেছি।’

খোয়াজ খিজির মুসা (আ.)–এর দিকে মুখ তুলে চেয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে কেন আমার মতো এক নগণ্য বান্দার কাছে পাঠালেন, তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’

মুসা (আ.) বললেন, ‘আমি খাঁটি মানুষের সন্ধান চাই। আল্লাহ বললেন, আপনিই সেই সন্ধান দিতে পারবেন।’

‘আল্লাহ বলেছেন এ কথা?’ প্রশ্নটা করেই খোয়াজ খিজির একটু ভাবলেন। বললেন, ‘আল্লাহর হুকুম আমাকে পালন করতেই হবে। এই নাও আমার চশমাটা। তোমার চোখে পরো। ওই যে রাজপথ দিয়ে শয়ে শয়ে লোক চলাচল করছে, দেখো, তাদের মধ্যে খাঁটি মানুষের দেখা পাও কি না? এই চশমা চোখে দিলেই তুমি দিব্যদৃষ্টি পাবে।’

মুসা (আ.) চশমাটি চোখে দিয়ে রাজপথের দিকে তাকালেন। আর অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, রাজপথের সব নর-নারী বিভিন্ন পশুর আকৃতি ধারণ করেছে। কেউ কুকুর, কেউ গাধা, কেউ শূকর, কেউ বিড়াল—হরেক রকম পশু তারা। তাদের মধ্যে একজনও মানুষ নেই। খোয়াজ খিজিরের দিকে চোখ ফেরাতেই মুসা (আ.) দেখলেন, একমাত্র খোয়াজই মানুষের আকৃতিতে রয়েছেন। মুসা (আ.) সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘হজরত, আমি আল্লাহর মহিমা বুঝতে পেরেছি। তিনি নিজেই আমাকে সঠিক মানুষের সন্ধান দিয়েছেন। আমাকে আপনি অনুমতি দিন। আমি আপনার কাছে জ্ঞানলাভের জন্য দীক্ষা নেব।’

কাহিনিটি এখানে শেষ নয়। কিন্তু পরবর্তী অংশ আমাদের এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম এবং বিশেষ সংখ্যার জন্য লিখতে বসে খোয়াজ খিজিরের কাহিনিটি স্মরণ হতেই আমারও ইচ্ছা হচ্ছিল, বাংলাদেশে যদি একালে এই মহাপুরুষের দেখা পেতাম, তাহলে তাঁর চশমাটি আমিও কিছু সময়ের জন্য ভিক্ষা চাইতাম। সেটি চোখে লাগিয়ে দেখতাম, দেশে এই যে শয়ে শয়ে পত্রিকা, বেশুমার সম্পাদক, তাঁদের মধ্যে কজন প্রকৃত সম্পাদকের সন্ধান পাই।

বহুদিন থেকেই আমি মনে মনে একটি শঙ্কা পোষণ করে আসছি। বাংলাদেশের সম্পাদক নামের প্রজাতিটি পৃথিবীর আদি যুগের অনেক প্রাণীর মতো বিলুপ্ত হতে বসেছে। অথচ এককালে তাঁরাই ছিলেন বিদেশি শাসকের বুকের ত্রাস এবং জ্ঞানে-গরিমায় শত্রু-মিত্র সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাতে কী? ডাইনোসোরাসও তো এককালে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অতিকায় প্রাণী। এখন তার বংশধারা লুপ্ত। কেবল তাদের ফসিল পাওয়া যায়। এমনও হতে পারে, বাংলাদেশে এখনো সম্পাদক নামক প্রজাতির যে দু-চারজন অবশিষ্ট আছেন, তাঁদের প্রয়াণের পর হয়তো ডাইনোসোরাসের কঙ্কালের মতোই তাঁদের কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা হবে, প্রদর্শনী হবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের মানুষ একদিন অবাক বিস্ময়ে জানবে, তাদের দেশে একদা সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, সত্যানুসন্ধানী একদল সংবাদপত্রসেবী ছিলেন, যাঁদের বলা হতো সম্পাদক। এঁরা এখন প্রায় লুপ্ত প্রজাতি। তাঁদের স্থান যাঁরা দখল কারেছেন, তাঁদের নাম মালিক-সম্পাদক। তাঁদের মধ্যে লুপ্তপ্রায় সম্পাদক প্রজাতির দু-একজন অবশ্য এখনো আছেন। তাঁরা মালিক এবং সাংবাদিক দুই-ই। বাকি সবাই কেবল মালিক। কস্মিনকালেও তাঁরা সাংবাদিক অথবা সংবাদপত্রসেবী ছিলেন না। টাকার জোরে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো কালোটাকা) তাঁরা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন এবং মালিকানার জোরে সম্পাদক হয়ে বসেছেন।

কোনো দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করার বিদ্যাবুদ্ধি, যোগ্যতা, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এই মালিক-সম্পাদকদের অনেকেরই নেই। তবে এঁদের কারও কারও আবার চক্ষুলজ্জা আছে। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকা দেওয়ার জন্য তাঁরা একজন যোগ্য সাংবাদিক খোঁজেন। তাঁকে ভারবাহী বা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মালিক-সম্পাদকের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে মালিকের অযোগ্যতার দায় বহন করে চলতে হয়। টাকার জোরে নিজের পত্রিকার সম্পাদক (অথবা তথাকথিত সম্পাদনা পরিষদের চেয়ারপারসন) হওয়ার পর কোনো কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী অথবা ব্যবসায়ী মালিক নিজের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে পত্রিকার নীতি ডিকটেট করেন, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটান এবং সৎ সাংবাদিকতার আদর্শকে বিসর্জন দেন। অনেক হঠাৎ-ধনী বা কালোটাকার অচ্ছুত মালিক পত্রিকা প্রকাশ করে সম্পাদক হন জাতে ওঠার জন্য, সমাজে কৌলীন্য অর্জনের জন্য। আমাদের মতো দেশে মালিক-সম্পাদক হওয়ার চেয়ে জাতে ওঠার আর কোনো সহজ রাস্তা নেই।

বাংলাদেশে যাবতীয় পেশার মধ্যে একমাত্র পত্রিকা-সম্পাদনার পেশাতেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা দরকার হয় না। হাতে সাদা-কালোটাকা থাকলেই হলো। জুতা সেলাইয়ের কাজেও এই পেশায় রত কারও কাছে কিছুদিন কাজ শিখতে হয়। হালে শু মেকার্স ট্রেনিং সেন্টার হয়েছে নানা অনগ্রসর দেশেও। বিলেতে হেয়ার কাটিং ও হেয়ার ড্রেসিং একটি অভিজাত পেশা। তাতে উচ্চশিক্ষা লাভের কলেজও রয়েছে। এসব স্কুল-কলেজে শিক্ষালাভ ছাড়া কাউকে কাঁচি ধরতে দেওয়া হয় না। আর বাংলাদেশে সংবাদপত্র সম্পাদনার কাজটি রাষ্ট্র পরিচালনার মতো সমান দায়িত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, যে সম্পাদকের অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য দেশের বা জাতির সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে, তাকে বিনা দ্বিধায় কলম ধরতে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

কলম চালনায় অপারগ মালিক-সম্পাদকদের দৌরাত্ম্য সম্ভবত আমাদের উপমহাদেশীয় সাংবাদিকতারই একটি বৈশিষ্ট্য। শুনেছি, কলকাতার মতো শহরেও শুধু টাকার জোরে এক নব্য ধনী বকলম মৎস্য ব্যবসায়ী একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদক হিসেবে নিজের নাম ছাপাচ্ছেন। যদিও সম্পাদনার প্রকৃত দায়িত্ব পালন করেন নির্বাহী বা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যাঁর নাম পত্রিকায় ছাপা হয় না। স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে দু-একজন মালিক-সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তাঁরা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন সম্পাদক, ওয়ার্কিং এডিটর। তাঁরা লিখতে জানতেন, পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালনে যোগ্য ছিলেন এবং অন্য কোনো পেশায় বা ব্যবসায়ে জড়িত ছিলেন না।

পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নাম ছেপে তাঁর সুযোগ নিয়ে অন্য লাভজনক ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে তাঁরা দুহাতে লাভের কড়ি গোনেননি; বরং অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে সাহসের সঙ্গে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরতে গিয়ে বারবার জেলজুলুম থেকে শুরু করে নানা নির্যাতন সহ্য করেছেন।

ধরা যাক, দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কিংবা দৈনিক সংবাদ-এর প্রয়াত সম্পাদক (মালিকানাতেও যাঁর অংশ ছিল বলে শুনেছি) জহুর হোসেন চৌধুরীর কথা। মানিক মিয়া টাকার জোরে মাটি ফুঁড়ে রাতারাতি দৈনিক ইত্তেফাক-এর মালিক-সম্পাদক হননি। দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশের আগে তিনি ছিলেন মাওলানা ভাসানী কর্তৃক নিযুক্ত ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক–এর সম্পাদক’। সেই কাগজেই ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ নামে রাজনৈতিক কলাম লিখে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা ও সাংবাদিক-প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তারও আগে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সঙ্গে যুক্ত থাকাকালে তিনি পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের কাছে কলাম লেখার হাতেখড়ি নেন।

মানিক মিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে আবুল মনসুর আহমদ (১৯৬৯ সালের জুন মাসে) দৈনিক ইত্তেফাক-এর ‘জাতি যে মানিক হারালো’ নামে যে স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি প্রকাশ করেন, তাতে কলকাতার ইত্তেহাদ-এ মানিক মিয়ার সাংবাদিকতায় শিক্ষানবিশির চমৎকার বিবরণ আছে। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৯ সালে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাক-এর পরিচালনা ও সম্পাদনার কাজেই সার্বক্ষণিকভাবে লিপ্ত ছিলেন এবং পত্রিকাটিতে প্রতিদিন ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নামে একটি কলাম (একমাত্র অসুস্থতা ও জেলে থাকার সময় ছাড়া) লিখেছেন। তাঁর এই রেকর্ড উপমহাদেশে আর কোনো কলামিস্ট ভাঙতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।

জহুর হোসেন চৌধুরীও সাংবাদিকতা শুরু করেন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা শহরেই। তিনি ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষার সাংবাদিকতাতেই দক্ষ ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন সংবাদপত্রেই মালিক-সম্পাদক নামক শ্রেণিটির দৌরাত্ম্য শুরু হয়নি তখনো। মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন মালিক নিজেদের পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন, তাঁরাও ছিলেন পেশায় মোটামুটি অভিজ্ঞ সাংবাদিক। সেকালেও সংবাদপত্র-জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন মূলত পেশাজীবী, অভিজ্ঞ, স্বাধীন মতামতের সম্পাদকেরাই।

তাঁদের অনেকেই সারা উপমহাদেশে খ্যাত ছিলেন। তাঁরা সবাই বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতেন না; কিন্তু তাঁদের শিক্ষা, জ্ঞান, বলিষ্ঠ মতামতের জন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর চেয়ে দেশবাসীর কাছে তাঁরা বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। বিদেশি শাসকেরাও তাঁদের ভয় করতেন, সমীহ করতেন।

সরকারকে পত্রিকা বন্ধ করার অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হবে কেন? বাংলাদেশেও এমন একটি গণতান্ত্রিক সুশীল পাঠকসমাজ গড়ে ওঠা অথবা গড়ে তোলা দরকার, যাদের সচেতন ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে অপসাংবাদিকতা বন্ধ হবে; সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের যারা শত্রু, সেই পত্রিকাগুলো জনসমর্থনের অভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।

সেকালের সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র সরকার, সোমনাথ লাহিড়ি, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, নজিউর রহমান চৌধুরী, ফজলুল হক সেলবর্ষি, মওলানা আহমদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রমুখের নাম এখন কিংবদন্তির মতো।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে, জাতিগঠনে, গণতান্ত্রিক সুশীল সমাজ সংগঠনে তাঁরা যে অবদান রেখে গেছেন, তা দেশের মানুষের কাছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকাকে এক বিশেষ আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।

এঁরা অধিকাংশই ছিলেন পেশাজীবী সম্পাদক; দু-একজন ছাড়া কেউ মালিক-সম্পাদক ছিলেন না। যাঁরা মালিক হয়েও সম্পাদক হয়েছিলেন, তাঁরা টাকার বা মালিকানার জোরে সম্পাদক হননি; যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার জোরে হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলেও স্বাধীন সংবাদপত্র ও সম্পাদকের স্বাধীনতার ব্যাপারটি মোটামুটি অবিভাজ্য ছিল এবং পেশাজীবী সম্পাদক শ্রেণির অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হওয়ায় আশঙ্কা দেখা দেয়নি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতৃত্বে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি ছিল কার্যত এই সম্পাদকদের আসন। হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন অবজারভার পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিক। ইংরেজি অবজারভার এবং বাংলা পূর্বদেশ—এ দুটি দৈনিকের মালিক ছিলেন তিনি। তাঁর টাকার জোর ছিল এবং নিজে লিখতেও জানতেন। অবিভক্ত বাংলায় দৈনিক আজাদ-এ তিনি স্বনামে কিছুকাল কলামও লিখেছেন। এই হামিদুল হক চৌধুরী নিজের একটি কাগজেরও মালিক-সম্পাদক হননি। বরং তাঁর কাগজ সম্পাদনার জন্য আবদুস সালামের মতো একজন জ্ঞানী ও দক্ষ সম্পাদককে খুঁজে বের করেছিলেন। পত্রিকার নীতিনির্ধারণে কোনো কোনো বিষয়ে মালিক ও সম্পাদকের মধ্যে মতানৈক্য হলে দুজনকে চোখ রাঙিয়ে উচ্চকণ্ঠে তর্ক করতেও আমি দেখেছি। এই ছিল সেদিনও মালিক ও সম্পাদকের সম্পর্ক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পর্কটি ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

স্বাধীনতা লাভের পরেই যেন সমাজের অন্যান্য স্তরের মতো সংবাদপত্র মহলেও একটা অরাজক অবস্থা এবং নৈরাজ্য দেখা দেয়। পত্রিকার সংখ্যা বাড়তে থাকে বটে, কিন্তু সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মানমর্যাদা এবং স্বাধীনতা ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ন হতে থাকে। নিউজপ্রিন্টের কালোবাজারির তখনকার লোভনীয় মুনাফার দিনে কিছু কিছু লোক এই ব্যবসায়ের লোভেও খবরের কাগজের প্রকাশক ও সম্পাদক হয়ে বসেন। এঁদের দৌরাত্ম্যে বাংলা সংবাদ-সাহিত্যের এককালের উঁচু মানের যে ক্ষতি হয়, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নামে যে অনাচার শুরু হয়, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

স্বাধীনতার পরে সম্পাদকের স্বাধীনতা এবং মর্যাদার প্রশ্নে গত ২৭ বছরে ঢাকার একাধিক দৈনিকে আমাকে কলাম লেখা বন্ধ করতে হয়েছে। প্রথমটি অধুনালুপ্ত সরকারি ট্রাস্ট পত্রিকা দৈনিক বাংলা। আমার বন্ধু তোয়াব খান তখন এই পত্রিকার সম্পাদক। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজপথে একটা বিক্ষোভ মিছিলের খবর কাগজে বড় করে ছাপার দরুন রাতারাতি তোয়াব খানকে সম্পাদক পদ থেকে অপসারণ করা হয়। আমি তখন দৈনিক বাংলায় ‘নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখছিলাম। অসমাপ্ত অবস্থাতেই সেই লেখাটি আমি বন্ধ করে দিই। তারপর দৈনিক বাংলায় আমার আর লেখা হয়ে ওঠেনি। দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে অপসারণের ক্ষতিপূরণের জন্য তোয়াব খানকে অবশ্য উচ্চ সরকারি পদ দেওয়া হয়েছিল। তাতে সম্পাদকের স্বাধীনতার যে ক্ষতি করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি।

দ্বিতীয় ঘটনাটি বছর কয়েক আগের। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু আজিজ মিসির বাংলাদেশের এক প্রবীণ সাংবাদিক। তাঁর আসল নাম সিরাজুল ইসলাম। পঞ্চাশের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী থাকাকালে তিনি গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য নাম বদল করে ঢাকায় পালিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি সাংবাদিক। স্বাধীনতার পর তিনি একটি দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত হন এবং দীর্ঘ কুড়ি-একুশ বছর এই পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমি ছিলাম এই পত্রিকার কলাম লেখক। পত্রিকার মালিকদের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো এবং ঘনিষ্ঠ। হঠাৎ কী হলো? এই আজিজ মিসিরও একদিন তাঁর পত্রিকা অফিসে কাজ করতে গিয়ে শুনলেন, তাঁকে এখনই প্রধান ক্যাশিয়ারের সঙ্গে দখা করতে হবে।

ক্যাশিয়ার তাঁকে একটি চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁর এত বছরের চাকরির পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দিলেন। অর্থাৎ পত্রপাঠ বিদায়। আজিজ মিসির সেদিন পত্রিকা অফিসে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তেও জানতে পারেননি তাঁকে এমন অসম্মানকর অবস্থার মধ্যে চাকরি হারাতে হবে। তাঁকে যে চিঠি দেওয়া হয়, তাতে এই অপসারণের কোনো কারণ দর্শানোও হয়নি। এই ঘটনার পর আমাকে কিছুদিনের মধ্যে এই পত্রিকাটি থেকেও সরে আসতে হয়েছিল। তাতে আমার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মনের স্বাচ্ছন্দ্য হারাইনি।

কোনো পত্রিকা থেকে কোনো সম্পাদক অবশ্যই অপসারিত হতে পারেন। বিলেতে বড় বড় কাগজেও হরহামেশা সম্পাদক বদল হচ্ছেন। কোনো কাগজ যখন পাঠকপ্রিয়তা হারায়, কাগজটির লেখা আর পাঠকেরা পছন্দ করেন না, তার সার্কুলেশন কমতে থাকে, তখন অবশ্যই পত্রিকার মালিকপক্ষ অথবা ডিরেক্টর বোর্ড নতুন সম্পাদক খোঁজেন।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেই এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য কেবল সরকারি খবরদারিই বড় হুমকি নয়; আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে কালোটাকা এবং স্বাধীন ও পেশাজীবী সম্পাদকদের দ্রুত অবলুপ্তি। আমার ধারণা, সৎ এবং সাহসী সম্পাদক ও সাংবাদিকেরাই সচেতনভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য এগিয়ে যেতে পারেন।

পুরোনো সম্পাদককে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে, পাওনার ওপরেও তাঁর আর্থিক ক্ষতি পূরণ করে দিয়ে এবং আগে থেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে অবসর দেওয়া হয়। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার দীর্ঘকালের সম্পাদক পিটার প্রেস্টনকে সম্প্রতি তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন সম্পাদক নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পত্রিকাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। তাঁকে ‘গার্ডিয়ান-অবজারভার গ্রুপের’ প্রধান উপদেষ্টা-সম্পাদক হিসেবে রাখা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া—সর্বত্রই জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা, প্রধান রাজনৈতিক কলামিস্টরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মতোই সমান প্রভাবশালী এবং মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।

বাংলাদেশের মতো সাবেক তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য মুক্ত সংবাদপত্র এবং স্বাধীন সম্পাদকদের অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি বেশি নির্ভর করে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন সাংবাদিক এবং মুক্তচিন্তার সুশীল পাঠক সমাজের ওপর। কেবল আইন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। আইন একটি রক্ষাকবচ মাত্র। এই স্বাধীনতাও মর্যাদা রক্ষার গ্যারান্টি নয়। নিজেদের জন্য এই গ্যারান্টি তৈরি করতে পারেন সচেতন সাংবাদিক এবং পাঠকসমাজ। তাঁরাই আমাদের বহু প্রত্যাশার সুশীল সমাজের আসল খুঁটি। এই খুঁটি ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। আবার এই গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন ছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবিবেকের অস্তিত্ব রক্ষা করারও কোনো বিকল্প পন্থা নেই।

সাবেক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আমরা সব ব্যাপারেই সরকারের মুখাপেক্ষী। এটা উপনিবেশ-যুগের মানসিকতা। আমরা অনেকে চাই সরকার অপসাংবাদিকতা, মৌলবাদী ও অসত্য প্রচারের পত্রিকাগুলো আইন করে বন্ধ করে দিন। আইন অবশ্যই দরকার। যেমন বিলেতের রেস রিলেশন্স অ্যাক্ট। এই আইনে বর্ণবাদীরা উৎখাত হয়নি। কিন্তু তাদের অত্যাচার থেকে অশ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশেও আইন হওয়া দরকার কাগজ বন্ধ করার জন্য নয়; হওয়া দরকার অশুভ, অসৎ, অপসাংবাদিকতার কবল থেকে জনসমাজকে মুক্ত ও সুস্থ রাখার জন্য। পত্রিকা বন্ধ করা নয়, উদ্দেশ্যমূলক, বিদ্বিষ্ট ও অসত্য প্রচারণার জন্য বিচার ও দণ্ডের আইনি ব্যবস্থা থাকা দরকার।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেই এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য কেবল সরকারি খবরদারিই বড় হুমকি নয়; আরও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে কালোটাকা এবং স্বাধীন ও পেশাজীবী সম্পাদকদের দ্রুত অবলুপ্তি। আমার ধারণা, সৎ এবং সাহসী সম্পাদক ও সাংবাদিকেরাই সচেতনভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য এগিয়ে যেতে পারেন। একশ্রেণির অর্ধশিক্ষিত এবং কালোটাকার অধিকারী মালিক-সম্পাদকের কাগজে চাকরি করা, তাঁর নীতিবহির্ভূত যেকোনো নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে দৃঢ় অস্বীকৃতি জানিয়ে সমাজে তাঁরা সৎ সাংবাদিকতার সুনাম ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাতে হয়তো তাঁদের কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, কিছুদিন অসম্ভব আর্থিক কষ্ট স্বীকার করতে হবে। কিন্তু ক্লেশ ও কষ্ট স্বীকার করা ছাড়া কবে কোন দেশে মহৎ কিছু অর্জন করা হয়েছে? ইউরোপে-আমেরিকায় দীর্ঘকাল সাংবাদিকদের অসম্ভব কষ্ট স্বীকার এবং সুশীল পাঠকসমাজের ক্রমাগত লড়াইয়ের পর এই দুই মহাদেশেই মুক্তচিন্তা এবং মুক্ত সাংবাদিকতার এমন অবাধ বিকাশ ঘটেছে। এবং গণতান্ত্রিক সমাজের অস্তিত্বও এতটা নিরাপদ হয়েছে।

সরকারকে পত্রিকা বন্ধ করার অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হবে কেন? বাংলাদেশেও এমন একটি গণতান্ত্রিক সুশীল পাঠকসমাজ গড়ে ওঠা অথবা গড়ে তোলা দরকার, যাদের সচেতন ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে অপসাংবাদিকতা বন্ধ হবে; সুশীল ও গণতান্ত্রিক সমাজের যারা শত্রু, সেই পত্রিকাগুলো জনসমর্থনের অভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীরা, সচেতন ও সৎ সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা কেবল পত্রিকায় বিবৃতি ছেপে অশুভ এবং গণশত্রু বলে চিহ্নিত পত্রিকা বা পত্রিকাগুলো বন্ধ করার দাবি না জানিয়ে মুক্তচিন্তার সুশীল পাঠকসমাজ এবং তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ রচনার কাজেই বেশি উদ্যোগী হলে একটি কাজের কাজ করবেন।

তাতে সামগ্রিকভাবেই দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক সমাজ ও ব্যবস্থার শত্রুদের প্রভাব ও তৎপরতা কমবে এবং ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। এ কথা আজ প্রমাণিত সত্য যে সুশীল গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক সৎ, সাহসী, মুক্তচিন্তার সংবাদপত্রের অধিকার রক্ষা, সাহসী ও স্বাধীন সম্পাদকদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দরকার একটি সচেতন সুশীল পাঠকসমাজ।

বাংলাদেশের সচেতন সম্পাদক, সাংবাদিক ও পাঠকসমাজ দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র এবং সন্ত্রাসমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কালোটাকার মালিক এবং তাঁদের অপপ্রচার ও স্বার্থসিদ্ধির অপসাংবাদিকতাকে প্রতিহত করুন। এই ব্যাপারে শুধু সরকারের ব্যর্থতার নিন্দা করলেই কর্তব্য শেষ হবে না। নিজেদের ব্যর্থতা সম্পর্কেও আমাদের সচেতন হতে হবে। পঞ্চাশের দশকে কবি-কমরেড গোলাম কুদ্দুসের লেখা কবিতার দুটি লাইন আজ বাংলাদেশের সব সম্পাদক ও সাংবাদিক বন্ধুকে সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই:

চাকুরি করবো চাকর রবো না

লক্ষ গলায় গর্জন

আজ দৈত্য বধের

সত্য করেছি অর্জন।

লন্ডন । ১৮ অক্টোবর রোববার। ১৯৯৮

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক