অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চলে গেলেন। যাওয়াটা যে নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলা যাবে না। বেশ কিছুদিন থেকে তাঁর অসুখ ক্রমেই গুরুতর হচ্ছিল এবং প্রতিদিনই আশার জায়গাটা সংকুচিত হচ্ছিল। তবু সবার প্রার্থনা ছিল, যেন তিনি ফিরে আসেন। তাঁর শূন্যতা তো পূরণ হওয়ার নয়। মহামারি–উত্তর বাংলাদেশকে আরও মানবিক করার জন্য তাঁর প্রজ্ঞা এবং দিকনির্দেশনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অনেক প্রার্থনার মতো এটিও অপূর্ণ রয়ে গেল।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে নিয়ে তাঁর জন্মদিনে লিখেছি, তাঁর ওপর আমার সম্পাদনায় যে সম্মাননাগ্রন্থ বেরিয়েছিল, তাতেও ‘ভূমিকা’ হিসেবে আমার একটি লেখা ছিল। কিন্তু সেগুলো লিখেছি উদ্যাপনের মেজাজে; এক চিন্তানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল এবং বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে বিশ্বাসী একজন মানুষের কর্মযোগের স্বীকৃতি হিসেবে, যার তালিকাটি প্রতিবছরই দীর্ঘ হচ্ছিল। অথচ আজ তাঁকে শ্রদ্ধা ও বিদায় জানাতে গিয়ে ক্রিয়া পদের অতীত কাল ব্যবহার করতে হবে, এই সত্য মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, তাদের কাছে তাঁর উপস্থিতি এতটাই জীবন্ত যে তা অতীত ভাবতে মন সায় দেবে না।
অনেকে অনেকভাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে পেয়েছেন, তাঁকে অনেকে দেখেছেনও নানাভাবে। তাঁর সতীর্থদের মধ্যে যঁারা বেঁচে আছেন, তাঁরা তাঁকে একভাবে দেখেন, তাঁর আত্মীয়স্বজন দেখেন আরেকভাবে। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি শিক্ষক, সহকর্মীদের কাছে পরামর্শদাতা বা পথপ্রদর্শক। সংস্কৃতিকর্মীরা তাঁর সান্নিধ্যে উদ্দীপ্ত হয়েছেন, যাঁরা সাহিত্য রচনা করেন, তাঁরা তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। আমার কাছে তিনি ছিলেন এক ভরসার জায়গা, যেমন ছিলেন দেশের মানুষের কাছে। তিনি কখনো শ্রেণিকক্ষে আমাকে পড়াননি, কিন্তু যেদিন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, তাঁকে আমি শিক্ষক হিসেবে এই জেনেছি, জেনেছি একজন আলোকিত আধুনিক মানুষ হিসেবে, আধুনিক, অর্থাৎ যিনি কালের যাত্রার সমান্তরালে চলেন, বিজ্ঞান ও দর্শনের যুক্তি ও সিদ্ধান্তগুলো মানেন, তবে নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে বাজিয়ে নিয়েই এবং যিনি ঐতিহ্যের মূল ভূমিতে পা রেখে বিশ্বের সঙ্গে নিজের চিন্তাচেতনাকে মেলান। প্রসন্ন মেজাজের মানুষ ছিলেন, চমৎকার এক রসবোধে সাধারণ একটি আলাপকেও স্মরণীয় করে রাখতে পারতেন। এক জীবনে অসাধারণ সব অর্জন ছিল তাঁর, কিন্তু এসব নিয়ে কোনো অহংকার ছিল না। সমবয়সীদের থেকে নিয়ে তরুণ শিক্ষার্থী, সবার সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল বিনয়ী।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একসময় আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একটা সময় দক্ষিণের উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে বের করে আনতে এবং নতুন দেশীয় ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় তাদের সমাজকে তৈরি করতে এই সংস্থা উৎসাহ জুগিয়েছে। পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্তির আন্দোলনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে হাতিয়ার আমরা তুলে নিয়েছিলাম, তাতে শাণ দেওয়ার কাজটি আরও অনেকের সঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান করেছিলেন। ষাটের দশক থেকেই তিনি সংস্কৃতির অঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন এবং এ দেশের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের একজন আদি প্রবক্তাও ছিলেন। সংস্কৃতিকে তিনি গতিশীল চিন্তা ও সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতেন, সে জন্য শিক্ষার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার ও প্রয়োগে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। একাত্তরে তাঁর সুযোগ হয়েছিল বিস্তৃত পরিসরে শুধু মুক্তিযুদ্ধকে নয়, মানুষের জেগে ওঠার, দেশাত্মবোধের শক্তিতে অশুভকে বরখাস্ত করার সমগ্র বিষয়টিকে সামনে থেকে দেখার। এ জন্য দেশ নিয়ে, মানুষ নিয়ে কখনো তিনি হতাশ হননি। তরুণদের নিয়ে তাঁর আশাবাদ ছিল, সমাজ নিয়ে তাঁর আশাবাদ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, একাত্তরে আমাদের সংস্কৃতির যে শক্তি মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্নে উদ্দীপ্ত করেছিল, সেই সংস্কৃতিকে জাগাতে পারলে, তার কাছে ফিরে গেলে অনেক কঠিন অর্জন আমরা করায়ত্ত করতে পারব।
মানুষ ও দেশ নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যে আদর্শগত ও বাস্তবধর্মী চিন্তা ছিল, সেগুলোর পক্ষে, নীতিনৈতিকতা ও আদর্শের প্রশ্নে যেসব সিদ্ধান্ত ছিল, সেগুলোর পক্ষে তিনি সারা জীবন সক্রিয় ছিলেন। আন্তোনিও গ্রামসির বর্ণনা ধার করে বলা যায়, তিনি ছিলেন একজন ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’, যাঁর কাজ ছিল মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কার এবং দেশের সংকটকালে মানুষকে পথ দেখানো। তিনি হইচই না করে তাঁর নিজের কাজগুলো করে গেছেন। ষাটের দশকের সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল, বিভেদমূলক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি সামনে ছিলেন। ঘাতক–দালাল নির্মূল কমিটিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথেও নেমেছেন। অথচ তাঁর মূল যে পেশা, শিক্ষকতা, তাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেননি। এমনকি ইমেরিটাস বা পরে জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার পরও নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত এক দিন তাঁর বিভাগের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সময় দিতেন। প্রত্যেকের জন্য তিনি সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের একটা জায়গা তৈরি করে দিতেন, যা তাঁর সঙ্গে তাদের দূরত্ব ঘোচাত। এত বড় মাপের একজন জ্ঞানসাধক ও শিক্ষক এত সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারেন, অন্তরঙ্গ হতে পারেন, আমাদের দেশে এর বেশি নজির নেই।
আমি এই লেখা লিখছি বলা যায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে। মন বলছে, স্যার আছেন, করোনার মাসগুলো শেষ হলে আবার দেখা হবে, গল্প হবে। কিন্তু যুক্তির কলম বলছে, স্যারের অনুপস্থিতি এখন ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। সে জন্য সম্মাননাগ্রন্থের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃতি দিলে হয়তো বর্তমান কাল ব্যবহার করেই তাঁকে নিয়ে কয়েক ছত্র লেখা হয়ে যাবে। আমি লিখেছিলাম, ‘আমার কাছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একজন সক্রিয় চিন্তার মানুষ...। এই সক্রিয় চিন্তার মানুষ তাঁর আবেগকে রাখেন বুদ্ধির শাসনে, ইতিহাস ও সময়কে দেখেন বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে, সংকটে-সন্তাপে থাকেন স্থিরচিত্র। এই মানুষের কাছে মানবিকতা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ গুরুত্ব পায়। সক্রিয় চিন্তার মানুষ অতীতকে আবিষ্কার করেন বইয়ের মধ্য দিয়ে, গবেষণার মধ্য দিয়ে; প্রকৃতিকে কল্পনা করেন মানুষ গঠনের পেছনে বড় একটি প্রভাবক হিসেবে এবং সংস্কৃতির শক্তিকে পেতে চান তার সকল শুদ্ধতা নিয়ে। এসবই আমি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মধ্যে পাই। সমকালীন ইতিহাসকে তিনি এক দীর্ঘ দৃষ্টিতে দেখেন, ফলে রাজনীতির পালাবদলে অথবা বিপর্যয়ে তিনি বিচলিত হন না...।’
স্যারের মাপের আরেকজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল আমরা কবে পাব, আমি জানি না। যখনই মানুষ বিপন্ন হয়েছে, পেশাজীবীরা বিশেষ করে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিবেকবান শিক্ষকেরা বিপদে পড়েছেন, তিনি তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সংখ্যালঘুরা যেখানেই নিপীড়িত হয়েছেন, স্যার তাঁদের সমব্যথী হয়েছেন, তাঁদের নিপীড়নকে দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। যখন যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি তা শতভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’-এর মতো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চই হোক, পরিবেশ আন্দোলনের মতো নিসর্গ বাঁচানোর কর্মসূচি হোক অথবা বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান হোক, যে কাজের দায়িত্ব তারা তাঁকে দিয়েছে, তার ষোলো আনা তিনি করেছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে একাডেমিক, বিষয়ভিত্তিক বা আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা ছাড়া কখনো সাত-আট মিনিটের বেশি বক্তৃতা দিতে দেখিনি। সভাপতির ভাষণ তিনি সারতেন দুই–তিন মিনিটে। অথচ প্রতিটি কথাই যেন বলা হয়ে যেত। এত সুন্দর করে গুছিয়ে এবং রসবোধের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন, মনে হতো বাংলা ভাষার যে শক্তিটা আমরা ভুলে গেছি, তা তিনি দুই মিনিটেই জাগিয়ে দিতেন। ভারত সরকার যখন তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিল, ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন সোনারগাঁও হোটেলে একটা সম্মাননার আয়োজন করল এবং একক বক্তৃতা হিসেবে স্যারকে নিয়ে কিছু বলার জন্য আমাকে অনুরোধ জানাল; আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম কোন ভাষায় বলব, যেহেতু অনেক বিদেশি সে অনুষ্ঠানে যাবে, ইংরেজিতে বলাটাই স্বাভাবিক। স্যার বললেন, বাংলায়। আমি খুব আনন্দ নিয়ে বাংলাতেই বললাম। বুঝলাম, বিষয়টি প্রত্যেকের মনঃপূত হয়েছে। তিনি নিজেও ইংরেজি বলতেন শুদ্ধ উচ্চারণে, অনর্গল সক্ষমতায়।
স্যারের কাছ থেকে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। তবে এ মুহূর্তে একজীবনে তিনি যা দিয়েছেন, তার উদ্যাপনটা আমরা করব এবং তাঁকে আমাদের চিন্তা, কাজ আর সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন স্মরণ করব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ