প্রায় সাত বছর আগের কথা। জাসদ নিয়ে লেখা বইটির বেশ কাটতি। বিএনপিকে নিয়ে লিখতে শুরু করেছি। এই দলের কাউকে তেমন চিনি না। দলটির বয়স আওয়ামী লীগ, ন্যাপ বা জাসদের তুলনায় কম। দলের দলিল-দস্তাবেজ তেমন নেই। যা পাচ্ছি, তার ওপর ভরসা করে বই লেখা কঠিন। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে শুরু করলাম দলের লোকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া। দলের মেনিফেস্টো, কর্মসূচি বা প্রচারপত্রে সুন্দর সুন্দর কথা থাকে। কিন্তু না-বলা কথা তো আছে অনেক। অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে উঠে আসে বিচিত্র সব তথ্য।
তো একদিন গেলাম বিএনপির এক প্রবীণ নেতার কাছে। দেখা করতে গিয়ে শুনি তিনি অসুস্থ। বাড়ির একজনকে বললাম, বিষয়টা খুবই জরুরি। তাঁর সঙ্গে আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে। তিনি জানেন, আজ আমি আসব। ১০ মিনিটের জন্য হলেও কথা বলতে চাই। লোকটি ভেতরে গিয়ে খবর দিল। বেরিয়ে এসে বলল, আপনি বসুন। তিনি আসছেন। আমার মনটা ভালো হয়ে গেল।
তিনি এলেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি অসুস্থ। বসলেন। আমি রেকর্ডার অন করলাম। শুরু হলো কথোপকথন। প্রথম দিকে কিছু গৎবাঁধা কথা। আমি চেষ্টা করছি ভেতরের খবর জানতে। আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে একটা নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা ঘোষণা দিয়েই নির্বাচন বর্জন করেছিল। একই সঙ্গে নির্বাচন প্রতিরোধেরও হুমকি দিয়েছিল। ঢাকাসহ সারা দেশে ওই সময় অনেক গন্ডগোল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, খুনোখুনি আর গাড়ি পোড়ানো হয়। দিনের পর দিন চলে ‘অবরোধ’। বাস চলাচল প্রায় বন্ধ।
একপর্যায়ে তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা নির্বাচনে গেলেন না কেন? তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, নীতিনির্ধারকদের একজন। তাঁর ভাষ্যটি জানা খুব দরকার। আমরা তো সবাই জানি, বিএনপি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করছিল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে—বিটুইন দ্য লাইনস। প্রকাশ্যে যা বলা হয়, তার বাইরেও কিছু কথা থাকে, যা পত্রিকায় ছাপা হয় না, মানুষ জানতে পারে না।
তিনি বললেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন নিয়ে দলের সবাই একমত ছিলেন না। এটা কোনো বিপ্লবী পার্টি নয় যে একটা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় চলে যাবে। ক্ষমতায় যেতে হলে বিএনপির মতো মধ্যবিত্তের একটি দলের নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। এই উপলব্ধি ছিল কারও কারও। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন অনেকেই। তাঁরা ভেবেছিলেন, একটা গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হবে। তাঁদের সামনে দৃষ্টান্ত ছিল ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলন।
তাঁর কাছ থেকে অভিযোগ পেলাম যে দলের কিছু লোক সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নির্বাচন বর্জনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। সরকার নাকি চাইছিল না বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। প্রমাণ করা কঠিন তাই অঙ্কটি উল্লেখ করলাম না। ২০১৬ সালে যখন বিএনপি: সময়-অসময় বইটি প্রকাশিত হলো, তাঁর দেওয়া ওই ‘গোপন’ তথ্য আমি প্রকাশ করিনি। আজ করলাম। মনে করেছি, ইতিহাসের স্বার্থে এসব অবমুক্ত করা দরকার। তা না হলে রাজনীতির মঞ্চের বাইরে নেপথ্যে কী হয়, তা জানা যাবে না।
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সুযোগটি আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই নিয়েছিল। দেশের পরিস্থিতি যা-ই হোক, ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসুক বা না আসুক, যেকোনো উপায়ে একটা নির্বাচন করিয়ে নিতে পারলে দ্বিতীয় মেয়াদে তাদের ক্ষমতায় থাকাটা জায়েজ হয়ে যাবে। এর ফল আমরা দেখলাম, ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থিত প্রার্থীরা ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হয়ে গেলেন। এটি নিয়ে অনেকেই গাঁইগুঁই করল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানালেন। পরে বুঝতে পারলেন, এ নিয়ে বেশি কথাবার্তা বলার মানে হয় না।
২০১৮ সালে হলো আরেকটি নির্বাচন। বড় দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না এলে নির্বাচন সাংবিধানিক বৈধতা পেলেও মানুষ এটা ভালোভাবে নেয় না। তারা মুখটিপে হাসে। তো আওয়ামী লীগ সরকার ভাবল, এবার বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে এবং আওয়ামী লীগকে তৃতীয় মেয়াদে সরকারে থাকতে হবে।
কৌশল জানা থাকলে পাল্টা কৌশলের ছক আঁকা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কৌশল সম্ভবত আওয়ামী লীগও জানে না। জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আওয়ামী লীগে আর কোনো নেতা নেই। এই দলের তিনিই ডিফেন্ডার, তিনিই গোলরক্ষক, তিনিই স্ট্রাইকার। প্রতিপক্ষের জালে বল ঢোকাতে তিনি মরিয়া। দেশের রাজনীতির ময়দানে তাঁর মতো কুশলী স্ট্রাইকার আর কে আছে?
আওয়ামী লীগ সরকার কথা দিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে গণভবনে প্রায় সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হলো। ‘সংলাপ’ তখন টক অব দ্য টাউন। তত দিনে বিরোধীদের একটা ঐক্যজোট হয়ে গেছে। তার নেতা ড. কামাল হোসেন, মূল শক্তি বিএনপি। গণভবনে ড. কামালের পছন্দের চিজ কেক খাওয়ানো হলো। প্রধানমন্ত্রী বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ দেখালেন। বিএনপির কেউ কেউ বললেন, সরকারের ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হবে না। কেউ কেউ বললেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের কৌশল ছিল ভুল। কিন্তু এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আরেকটি ভুল।
বিএনপি নির্বাচনে গেল, কিন্তু ঘটে গেল অভাবনীয় একটি ব্যাপার। বিএনপি ও তার মিত্ররা ছয় থেকে সাতটি আসন পেল। বলা যায়, তাদের ছয় থেকে সাতজনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে জিতিয়ে আনা হলো। তখন একটা কথা চাউর হলো—রাতের ভোট। বিএনপি স্বপ্নেও ভাবেনি, এ রকম একটি অ্যান্টিক্লাইমেক্স অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। দেশের মানুষও ভাবেনি।
২০২৩ সালের শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুতে হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। বিএনপি এখন ২০১৪ সালের দাবিতে ফিরে গেছে। নতুন কিছু শব্দ রাজনৈতিক ভোকাবুলারিতে ঢুকে গেছে—নির্বাচনকালীন সরকার, জাতীয় সরকার ইত্যাদি।
পরপর দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই রকম কৌশল নিয়ে নির্বাচনে পার পেয়ে যায়। এটা নিশ্চয়ই তাদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশ হবে। সে জন্য চাই বিপুল আয়োজন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ধারাবাহিকতা আছে বলেই উন্নয়ন হচ্ছে। যারা উন্নয়ন চায় না, কেবল তারাই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। ইঙ্গিতটি খুব স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায়।
গত দুটি নির্বাচনে নির্বাচনব্যবস্থার বারোটা বেজে গেছে। প্রশ্ন হলো, পরবর্তী নির্বাচনটি কেমন হবে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—২০১৪ আর ২০১৮ তো গেল। এবার আওয়ামী লীগ কী কৌশল নেবে? পুরোনো কৌশলের তো পুনরাবৃত্তি হবে না।
কৌশল জানা থাকলে পাল্টা কৌশলের ছক আঁকা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কৌশল সম্ভবত আওয়ামী লীগও জানে না। জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আওয়ামী লীগে আর কোনো নেতা নেই। এই দলের তিনিই ডিফেন্ডার, তিনিই গোলরক্ষক, তিনিই স্ট্রাইকার। প্রতিপক্ষের জালে বল ঢোকাতে তিনি মরিয়া। দেশের রাজনীতির ময়দানে তাঁর মতো কুশলী স্ট্রাইকার আর কে আছে?
রাজনীতি ফুটবল খেলার মতোই। এখানে বলের দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়, ফাউল প্লে হয়, মারামারি হয়, হাত দিয়ে বল ছুঁয়ে গোলে পাঠালেও তা অসিদ্ধ হয় না। জেতাটাই আসল কথা। এটা সত্য যুগ নয় যে নীতিশাস্ত্র মানতে হবে।
নির্বাচনে কাউকে জিততে হলে যতটা না ভোটে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করতে হবে কৌশলের ওপর। নির্বাচনের এখনো বাকি আছে দেড় থেকে দুই বছর। দেখা যাক, আওয়ামী লীগ কী কৌশল নেয়।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক