খবরটি তাক লাগানোর মতোই। একাদশ জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছিলেন ৪ হাজার ২৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী। প্রতিটি আসনে ১৩ জন। আর সংরক্ষিত ৪৩টি নারী আসনের জন্য আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন ১ হাজার ৫১০টি। প্রতিটি আসনের জন্য ৩৫ জন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের জাতীয় সংসদে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা অনেক অনেক বেশি। যদিও সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কেউ কেউ সাধারণ আসনেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সেখানে ব্যর্থ হয়ে এখন সংরক্ষিত আসনের জন্য লড়ছেন। যেভাবেই নির্বাচিত হোন না কেন, তাঁর পরিচয় সাংসদ। জনপ্রতিনিধি। অতীতে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত অনেক সাংসদ সাধারণ আসনে নির্বাচিত অনেক সাংসদের চেয়ে ভালো ভূমিকা পালন করেছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নারী নেত্রীরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন চলচ্চিত্রজগৎ ও ছোট পর্দার তারকারা। আছেন অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত নারীও। সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী বেশি হওয়ার কারণ, দলীয় মনোনয়ন পেলেই সাংসদ হওয়া শতভাগ নিশ্চিত।
বাংলাদেশের সংসদে, প্রথাগতভাবে, সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতেন; বিরোধী দলের নারী প্রার্থীরা সেই সুযোগ পেতেন না।
তবে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী অনুযায়ী, ২০০৪ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনে নির্ধারণ করা হয় যে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে (সে সময় ৪৫টি) একটি দল থেকে নির্দিষ্টসংখ্যক নারী সাংসদকে সুযোগ দেওয়া হবে; এবং তা হবে সংসদে ওই দলের কতজন প্রতিনিধি রয়েছেন, তার অনুপাতে। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন যদি নির্বাচিত সাংসদ হন, তাহলে ওই দল থেকে একজন প্রার্থী সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হবেন।
সেই সমীকরণ অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবেন ৪৩ জন, জাতীয় পার্টির ৪ জন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২ জন এবং স্বতন্ত্র এবং অন্যান্য দলের আরও ১ জন। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সাংসদেরা এখনো শপথ নেননি। তাঁরা যদি শেষ পর্যন্ত শপথ না নেন, তাহলে দুটি সংরক্ষিত আসন আপাতত শূন্য থেকে যাবে।
সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদের নির্বাচিত করে থাকেন সাধারণ আসনে নির্বাচিত সাংসদেরা। এটি কেতাবের কথা। বাস্তবে সেখানে কোনো নির্বাচন হয় না। যতটি আসন আছে, ঠিক ততজনকে আনুপাতিক হারে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ কারণে ভোটাভুটির দরকার হয় না।
মাননীয় আইনপ্রণেতাদের অনুরোধ করব, তাঁরা আইনটি আরেকটু সংশোধন করুন। সাধারণ আসনের মতো যে দল যতজন খুশি মনোনয়ন দিক অথবা এটি উন্মুক্ত রাখুক।
এরপর সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের ভোট দেবেন সাধারণ আসনের ৩০০ সাংসদ। তাতে দুটি কাজ হবে—
এক. দলীয় মনোনয়নই সংরক্ষিত আসনে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি হবে না।
দুই. সাধারণ আসনে নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের বিজয়ীদের মধ্যে রেষারেষি থাকবে না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলেও তাঁরা ৩০০ সাংসদ দ্বারা নির্বাচিত হবেন। এটি অনেকটা আইয়ুবের বেসিক ডেমোক্রেসির মতো পরোক্ষ ভোট। তারপরও তো ভোট। কিন্তু এখন তো ভোটই হচ্ছে না। দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ক্ষেত্রে নারী আসনে আওয়ামী লীগের ১ হাজার ৫১০ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রকাশ্যে ভোটাভুটি দাবি করতে পারেন। এতে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি ক্ষীণ সুযোগ থাকবে।
সমস্যা শুধু আওয়ামী লীগে নয়; সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতেও মনোনয়ন–সমস্যা কম নয়। দলের প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর আগে সংরক্ষিত আসনের জন্য একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন স্পিকারের কাছে। এখন আবার বলা হচ্ছে, তালিকা রদবদল হতে পারে। অর্থাৎ ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট—আমার সর্বশেষ বাতিল।
দলীয় মনোনয়নই চূড়ান্ত হোক আর বেসিক ডেমোক্রেসির কায়দায় নির্বাচনের মাধ্যমে হোক, প্রতিটি সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের যে ৩৫ জন করে মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন, তার মধ্যে নির্বাচিত হবেন মাত্র একজন। তাঁদের আগাম অভিনন্দন জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে যে ৩৪ জনই বাদ পড়বেন, তাঁদের প্রতি অগ্রিম সমবেদনা। পরবর্তী সংসদের জন্য তাঁরা চেষ্টা করবেন।
সংরক্ষিত আসনের সাবেক সাংসদ সাবিনা আক্তার তুহিন বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নারী সাংসদ নির্বাচন না করে একজন নারীর অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাংসদ নির্বাচন করলে সংরক্ষিত আসনের এমপিরা সংসদে আরও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবেন। তিনি সাংসদ থাকতে কথাটি বললে আরও খুশি হতাম।
আরও পড়ুন:
প্রতি আসনের জন্য লড়ছেন ৩৫ জন