সম্প্রতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের যে পরিসংখ্যান সরকার দিয়েছে, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলে সন্দেহ ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে সাড়ে পাঁচ মাস ধরে অর্থনীতিতে যে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নেমে এসেছে, তার অভিঘাতকে লঘু করার জন্য প্রবৃদ্ধির এই অবিশ্বাস্য হার ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের সোচ্চার অভিমত।
২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ সাড়ে তিন মাস যেভাবে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল, সেখানে কী ম্যাজিকে আগের সাড়ে আট মাসের প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে এই অচিন্তনীয় নেতিবাচক প্রবণতাগুলোকে উল্টে দিয়ে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলো, সেটা বিশেষজ্ঞদের কাছে গালগপ্পো মনে হয়েছে। অবিশ্বাসের আরেকটা কারণ হলো বর্তমান অর্থমন্ত্রী যখন পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, তখনো তিনি আগ বাড়িয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতেন বলে অভিযোগ আছে। উল্লেখ্য, বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা।
জিডিপির পাঁচটি উপাদান বা কম্পোনেন্ট হলো ভোগ+বিনিয়োগ+সরকারি ব্যয়+রপ্তানি আয়-আমদানি ব্যয়। ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাড়ে তিন মাস ধরে এই পাঁচ উপাদানের প্রতিটিই মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে বলে সরকারই তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে। সামষ্টিক ভোগব্যয়ের মারাত্মক পতনের কারণে দেশের ছোট-বড়-মাঝারি অধিকাংশ উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ক্রয়ক্ষমতা সংকোচন করেছেন, লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।
অতএব সামষ্টিক ভোগব্যয় ওই সাড়ে তিন মাসে মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। দেশের মোট বেসরকারি বিনিয়োগ আগের বছরের জিডিপির প্রায় ২৪ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ শতাংশে নেমে গেছে বলে সরকারই তথ্য দিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সরকারি রাজস্ব আয় বাজেটের প্রাক্কলিত অঙ্কের চেয়ে ৮৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে বলে সরকার স্বীকার করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় সংশোধিত এডিপির লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ হয়েছে, অন্যান্য বছর যেখানে তা ৯০-৯৫ শতাংশ হয়, এটাও সরকারি স্বীকারোক্তি। (সংশোধিত এডিপিও আবার মূল বাজেটের প্রাক্কলিত এডিপি থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল।) ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ (মানে গত বছরের চেয়ে ৬৮৬ কোটি ডলার) কমে গেছে বলে সরকার তথ্য দিয়েছে। অর্থবছরের আমদানি ব্যয়ও কমেছে, তবে রপ্তানি আয়ের সংকোচনের হারের তুলনায় অনেক কম। তাহলে কি ভোজবাজিতে সরকার ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এই খাতওয়ারি মারাত্মক বিপর্যয়ের কোনো আসরই পড়ল না? অর্থমন্ত্রী অঙ্কটা মিলিয়ে দেবেন কি?
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অনলাইন প্রেস কনফারেন্সে দাবি করেছে, তাদের গবেষণা মোতাবেক ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নির্ণীত হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। তাদের মতে, সরকারের ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার ঘোষণা এই হারকে একটি ‘রাজনৈতিক সংখ্যায়’ পরিণত করে ফেলেছে, যা অনভিপ্রেত। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সিপিডির ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারকে ‘আন্দাজনির্ভর’ আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সিপিডি কোন প্রক্রিয়ায় তাদের জিডিপির বিকল্প হার নির্ধারণ করেছে? তাঁর দাবি, বিবিএসের পরিসংখ্যানকেই সিপিডি ‘কাঁচামাল’ হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের তো আলাদা পরিসংখ্যান সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই। অতএব কীভাবে তারা ওই পরিসংখ্যানে পৌঁছাল?
এখন অর্থমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জের জবাবে সিপিডি তাদের বিকল্প পরিসংখ্যানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলে জাতি উপকৃত হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সিপিডি বিবিএসের খাতওয়ারি পরিসংখ্যানগুলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলে সরকারঘোষিত ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি-প্রবৃদ্ধির হারটি যে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশিত ‘ডেটা ডক্টরিং-এর ফসল, সেটা প্রমাণ করতে পারবে। বাংলাদেশ জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করায় সফল দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। অতএব ডেটা ডক্টরিং করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে ‘রাজনৈতিক কারসাজি’অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পদক্ষেপ (কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ) বিবেচিত হওয়া উচিত। করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বের সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়ে ফেলেছে, এমনকি অধিকাংশ দেশে প্রবৃদ্ধির হার নেগেটিভ হয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশে এই মহা বিপর্যয়কর মহামারির অভিঘাত তেমন বেশি হয়নি বললে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?
এমনিতেই আমাদের জানা আছে যে এই ডেটা ডক্টরিংয়ের অভিযোগটি বাংলাদেশের সব সরকারের বিরুদ্ধেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পুরোনো অভিযোগ, যদিও তারা সরাসরি এই কথা উচ্চারণ করে না। সরকারঘোষিত জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বহুদিন ধরে গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। এমনকি বিবিএস প্রকাশিত অন্যান্য ‘ভাইটাল পরিসংখ্যান’কেও ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো-কমানো হয় বলে একটা ধারণা গেড়ে বসেছে পরিসংখ্যান-প্রকাশনা ব্যবহারকারী দেশ-বিদেশের সংস্থাগুলোতে, এটাও ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। এই সন্দেহ অমূলক নয়। উদাহরণ হিসেবে নিচের অপকৌশলগুলোর উল্লেখ করা যায়:
১) বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যাকে সরকার কমিয়ে দেখায়, ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হারকে ১ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত সংস্থা ইউএনএফপিএর হিসাবমতে বাংলাদেশের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনো ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।
২) বাংলাদেশের মোট নমিনাল জিডিপিকে ‘কম দেখানো জনসংখ্যা’দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু জিডিপি কৃত্রিমভাবে বাড়ানো যায়। সম্প্রতি সরকার দাবি করেছে যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি আগের বছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ৩০ জুন ২০২০ তারিখে ২ হাজার ৬৪ ডলারে পৌঁছে গেছে।
৩) দেশের মূল্যস্ফীতির হারকে প্রকৃত হারের চেয়ে কম দেখানো হয়, যাতে নমিনাল জিডিপি থেকে রিয়াল জিডিপি হিসাব করার সময় মাথাপিছু রিয়াল জিডিপিকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ফেলা যায়।
৪) দেশের জনগণের সাক্ষরতার হারকে সরকার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায়, যেটাকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) হিসাব করার জন্য গ্রহণযোগ্য মনে করছে না।
এ দুর্ভাগ্যজনক খাসলতটি প্রায় সব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বহুদিন ধরেই দৃঢ়মূল হয়ে রয়েছে রাজনীতির কারণে। পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের ‘ডিকেড অব প্রোগ্রেসের’ সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ৪-৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু তাতে কি পূর্ব পাকিস্তানকে ঔপনিবেশিক বঞ্চনার শিকার করার সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া গেছে? ইংরেজিতে প্রচলিত এ-সম্পর্কিত একটা প্রবচন আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা আছে, ‘দেয়ার আর থ্রি কাইন্ডস অব লাইস: লাইস, ডেমড লাইস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস’ (তিন ধরনের মিথ্যা রয়েছে: মিথ্যা, নির্জলা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান’। বেঞ্জামিন ডিজরেইলিকে বচনটির কৃতিত্ব দেওয়া হলেও বিতর্ক আছে এর উৎস সম্পর্কে।)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘যাহা রচিবে তাহাই সত্য, যাহা ঘটে তাহা সত্য নহে’। বাংলা বচন-প্রবচনে সমস্যাটি তুলে ধরা হয় ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ বলে। অতএব ডেটা ডক্টরিংয়ের সমস্যাটি অতি পুরোনো এবং বহুল-প্রচলিত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহের সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা এই ‘রাজনৈতিক ডেটা ডক্টরিং’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকারি পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাপাসিটি-বিল্ডিংয়ের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান এসেছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে, কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক ফায়দাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় এসব দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে ব্যয়িত এই বিপুল অর্থ পানিতে পড়েছে বলা চলে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটিও বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের কল্যাণে গত ৪৯ বছরে বহুগুণ বেড়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ডেটা ডক্টরিং করতে বাধ্য করার এই বদখাসলত বন্ধ না করলে বিবিএস অদূর ভবিষ্যতে কখনোই একটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্তের সূতিকাগার হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না, এটা কি আমাদের শাসকেরা উপলব্ধি করেন?
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক