অরুণাচল নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কেন
কিছুদিন আগেও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র উত্তেজনাময় সীমান্ত ছিল ভারত-পাকিস্তানের কাশ্মীর এলাকা। এখন বাংলাদেশ ছাড়া এ অঞ্চলের প্রায় সব আন্তদেশীয় সীমান্তে নিয়মিত রক্ত ঝরছে। কেউ কেউ দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান দশককে বলছেন ‘সীমান্ত বিবাদের দশক’। সর্বশেষ পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে প্রায় ২০ জন মারা গেল। এর মধ্যে চীন-ভারত সীমান্ত বৈরিতা প্রায় স্থায়ী আকার নিয়েছে। এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে ছড়াচ্ছে সেটা। লাদাখের পর সবার নজর এই মুহূর্তে অরুণাচল সীমান্তে। ভুটানের পূর্ব সীমান্তে চীন নতুন করে কিছু এলাকা দাবি করায় ভারতে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভুটানের ওই এলাকা পশ্চিম অরুণাচলের লাগোয়া। ভারত এসব এলাকা ভুটানকে ছেড়ে দিয়ে দেশটির সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেছিল একদা। চীন এখন থিম্পুর কাছে সেসব এলাকা চাইছে। কিন্তু ভারতের অনুমতি ছাড়া ভুটানের পক্ষে—ইচ্ছা থাকলেও চীনকে কোনো ছাড় দেওয়া অসম্ভব।
ভারতের কাছে ‘অরুণাচল’—চীনের কাছে ‘দক্ষিণ তিব্বত’
পুরোনো ইতিহাসে অরুণাচল তিব্বতের অংশ ছিল। এখন অরুণাচল সম্পূর্ণই ভারতের নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিকভাবে ভারতের তরফ থেকে অরুণাচল নিয়ে কোনো বিতর্কই পাত্তা দেওয়া হয় না। অথচ চীনের স্কাই ম্যাপের মানচিত্রে অরুণাচলকে তাদের দেখানো হয়। স্কাই ম্যাপ দেশটির ডিজিটাল মানচিত্র বানায়। তারা অরুণাচলকে বলে ‘লোয়ার তিব্বত’। কখনো কখনো ‘দক্ষিণ তিব্বত’। চীনের মতে, একসময় দালাই লামারাই লোয়ার তিব্বত শাসন করতেন। যেহেতু তিব্বত এখন চীনের হানদের নিয়ন্ত্রণে, সুতরাং অরুণাচলেরও মালিক তারা।
অরুণাচল যেভাবে তিব্বত থেকে আলাদা হয়েছিল
এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের আসার আগে তিব্বত একরূপ স্বাধীনই ছিল। ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন তিব্বতে সৈন্যদল পাঠিয়েছিলেন বলে সাক্ষ্য মেলে। প্রায় এক হাজার তিব্বতি প্রতিরোধকারীকে হত্যা, কিছু সুযোগ-সুবিধা এবং আনুগত্য আদায় করে পরের বছর সেই অভিযান শেষ হয়। রাশিয়া ও নিজেদের মধ্যে একটা অনুগত প্রাচীর হিসেবে তিব্বতকে দেখতে চাইছিল ভারতের তখনকার ঔপনিবেশিক শক্তি। ১৯১০ সালে চীনের কুইং রাজবংশের দখলদারির শিকার হয় তিব্বত। ১৯১২-১৩ সালের দিকে কুইং বংশের পতনের সুযোগ নিয়ে তিব্বত স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ সময় থেকে এই অঞ্চলের সীমানা বিতর্ক ও বিরোধের শুরু। ভারতের ঔপনিবেশিক শাসকেরা ৮৯০ কিলোমিটার লম্বা ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে তিব্বতের সঙ্গে সীমানা হিসেবে ঠিক করে। চীনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তিব্বত ১৯১৪ সালের শিমলা কনভেনশনের মাধ্যমে এটা মেনে নেয়। ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণে ছিল অরুণাচল। এই লাইনকে সীমান্ত মানলে অরুণাচলের ভারতভুক্তি ন্যায্যতা পায়। কিন্তু শিমলা কনভেনশনে ম্যাকমোহনের পাথর দিয়ে টানা সীমান্তকে মেনে আসেনি চীন। তাদের প্রতিনিধি ইভান চেন কনভেনশনের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেননি। তিব্বতকে স্বাধীন একটা পক্ষ হিসেবেও মানত না তখন চীন। তিব্বতও সে সময় বলে রেখেছিল, ‘চীন মেনে নিলেই কেবল লাইনটি কার্যকর হবে’। ইতিমধ্যে ওই ‘লাইন’ ধরেই ১৯৩৭ থেকে ভারতীয় মানচিত্র তৈরি হতে থাকে। এই মানচিত্রের জোরেই ভারত অরুণাচলকে নিজের বলছে।
ভারতের ঔপনিবেশিক শাসকেরা ম্যাকমোহন লাইনকে সীমান্ত ধরে অরুণাচলকে আসামভুক্ত করলেও এর ভুটান–সংলগ্ন তাওয়াং এলাকাটি তিব্বতিদের শাসনেই চলতে থাকে। আসামের গভর্নর তাতে আপত্তি তোলেননি কখনো। বৃহত্তর আসাম তখন ‘ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’ নামে পরিচিত ছিল। এর মাঝেই ১৯৪৭ সালে তিব্বতের দালাই লামা (যিনি এখনো বেঁচে) অরুণাচলের আরও কিছু এলাকা দাবি করে ‘ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’-এর কাছে চিঠি লেখেন। এর অর্থ দাঁড়ায় তাওয়াং ছাড়াও অরুণাচলের আরও কিছু এলাকা তিব্বত নিজের মনে করত। এর মধ্যেই ১৯৫১ সালে চীন তিব্বতের দখল নেয়। এই উত্তেজনার মধ্যে ভারত তাওয়াং দখল করে নেয়। অর্থাৎ পুরো অরুণাচল তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
এর পরের ইতিহাসের বিবরণ না দিলেও চলে। ব্রিটিশ সূত্রে ভারত অরুণাচল নিয়ন্ত্রণ করছে—এই জনপদের সঙ্গে মূল ভারতের কোনোই সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল না। একইভাবে চীনও তিব্বতের মালিক ১৯৫১ সালের দখলসূত্রে। দখলদারির আগে মূল চীনের হানদের সঙ্গে তিব্বতের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল সামান্যই।
অরুণাচলের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চীন-ভারতকে অসুবিধায় ফেলে
ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর ভারতের অধীনে অরুণাচলের ইতিমধ্যে ৭৩ বছর পেরিয়েছে। এখানকার জনসংখ্যার বড় অংশ স্থানীয় বিভিন্ন আদিবাসী। ১৪ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ তারা। তিব্বতি আছেন ১০ ভাগ। বাকিরা আসাম ও নাগাল্যান্ড থেকে যাওয়া অভিবাসী। ধর্মবিশ্বাসে হিন্দুরা সংখ্যালঘু—২৯ ভাগ। বাকিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকৃতি পূজারি আদি ধর্মের মানুষ—যাদের একাংশ খ্রিষ্টান হচ্ছেন এখন। প্রায় ১৫ ভাগ বৌদ্ধ আছে সেখানে। ভাষা আছে ৫০টির মতো। হিন্দিভাষী মাত্র ৭ ভাগ।
ভাষা, বিশ্বাস ও জাতিগত পরিচয়ে অরুণাচলের বৈচিত্র্য চীন-ভারত উভয়ের জন্য অসুবিধাজনক। জনপদটি যে ঐতিহাসিকভাবে তাদের, এমন দাবির সাংস্কৃতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া উভয়ের জন্য কঠিন। সে রকম দাবি কিছুটা করতে পারে তিব্বতের লাসা। অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী প্রেমা খান্ডুও তাঁর রাজ্যের সঙ্গে চীনের সীমান্তকে নিয়মিত ‘ভারত-তিব্বত সীমান্ত’ বলে উল্লেখ করেন। স্পষ্টত, এটা চীনের জন্য অসহনীয় এক আক্রমণ। প্রেমা খান্ডু অরুণাচলে বিজেপির সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে তাঁর কথার দায় ক্ষমতাসীন বিজেপিকে না নিয়ে উপায় নেই।
অরুণাচলের তিন দিকে চীনের অবকাঠামো
১৯৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধের পর গত ১৫ জুনের লাদাখকাণ্ডের আগে পর্যন্ত উভয় দেশের মধ্যে বড় সংঘর্ষ হয়েছে তিনটি। এর দুটি হয়েছে অরুণাচল সীমান্তে। ১৯৭৫ সালে আসাম রাইফেলসের চারজন সৈন্যকে পিপলস লিবারেশন আর্মি হত্যা করে প্রদেশটির পশ্চিমের জেলা তাওয়াংয়ে। একই জেলায় ১৯৮৬ সালের আগস্টে আরেক দফা উত্তেজনা বেধেছিল। এসব সংঘর্ষকে ভারত-চীন প্রকাশ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখিয়েছে। অরুণাচলের মালিকানার দাবিও পরস্পরের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিল। লাদাখ অধ্যায়ের পর পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে।
কিছুদিন আগে অমিত শাহ যখন অরুণাচল যান, চীন প্রবল আপত্তি তোলে। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে তারা ‘সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করে। বিবৃতির এই ভাষা বলছে, যেকোনো সময় চীন এই অঞ্চল নিয়ে আক্রমণাত্মক কূটনীতিতে যেতে পারে। অরুণাচল থেকে নির্বাচিত লোকসভার এমপি তাপির গাও’ও তা–ই মনে করেন। তিনি ওই অঞ্চলের অঞ্জ জেলায় চীনের সৈন্যদের চলাচল এবং বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির কথা বলছেন প্রায়ই। দেশের নেতৃবৃন্দকে লিখিতও জানিয়েছেন বিষয়টি। ভারতীয় রক্ষীরা তাঁর কথা সত্য নয় বললেও গাওয়ের দাবি অসত্যও নয়। এ বছর এপ্রিলে অরুণাচলের ভেতর থেকে চীনের সৈনিকেরা বেশ কয়েকজন নাগরিককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, যাদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা পরে বৈঠক করে ছাড়িয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে সীমান্ত লঙ্ঘন ঘটেছে বলেই এমন ঘটতে পারল।
তাওয়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, অরুণাচলকে ঘিরে চীন প্রচুর অবকাঠামো বানাচ্ছে। কেবল রাজ্যটির পশ্চিমে নয়, সর্বপূর্বের অঞ্জ জেলায় এবং সর্বোত্তরের আপার-শুভনশ্রীতেও তৈরি হচ্ছে অনেক রাস্তাঘাট-ব্রিজ। অর্থাৎ কৌশলগতভাবে চীন অরুণাচলে পূর্ব-উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে চাপ তৈরি করছে। আপার-শুভনশ্রীর ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার ভেতরেও চীনের সৈনিকদের দেখা যায় বলে স্থানীয় আদিবাসীরা মাঝেমধ্যেই সাংবাদিকদের জানায়। এমপি গাওয়ের ভাষ্যমতে, আপার–শুভনশ্রীর নতুন মাজা এলাকায় একসময় ভারতীয় একটা সীমান্তচৌকি ছিল। ওই পুরো এলাকাটি এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে।
এসবের বাইরে চীন তিব্বতে অরুণাচলের গা ঘেঁষে লাসা থেকে লিনজি পর্যন্ত প্রায় ৪৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসাচ্ছে। এই রেললাইন ১২০টি ব্রিজ এবং ৪৭টি টানেলের ভেতর দিয়ে যাবে। নিজেদের সীমান্ত লাগোয়া জনপদে চীনের উচ্চাভিলাষী এসব প্রকল্প স্বভাবত ভারতকে উদ্বিগ্ন করে। তবে চীনের জন্য অরুণাচল সীমান্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। সীমান্তসংলগ্ন লুনজি কাউন্টিতে ৫৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মূল্যবান খনিজ রয়েছে। সেখানে চীন এরই মধ্যে মাইনিংও শুরু করেছে।
সীমান্তের এপারে ভারতও প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে
অরুণাচল নিয়ে ভারতের প্রধান সমস্যা হলো চীন ইঙ্গিত দিচ্ছে ম্যাকমোহন লাইন মানে না তারা। চীনের কথা বেশ সোজাসাপ্টা। লাসার লামারা মেনে নিলেও তারা কখনো ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে ব্রিটিশদের সম্মতির কথা জানায়নি। এ অবস্থায় অরুণাচল বাঁচাতে ভারতের জন্য বিকল্প থাকে একটাই। বিশ্বের নতুন সামরিক পরাশক্তি চীনের গরম নিশ্বাসের মুখে ভারতকে ব্রিটিশ সূত্রে পাওয়া এলাকাটি রক্ষায় ভরসা করতে হচ্ছে মূলত অস্ত্রপাতি ও সৈন্যদের ওপর। সীমান্তের এপারে অবকাঠামো গড়ছে তারাও। আসাম ও অরুণাচল সীমান্তে দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু এমনভাবে বানানো হয়েছে, যাতে সেখান দিয়ে ৬০ টন ওজনের ‘অর্জুন’ ও ‘টি-৭২’ ট্যাংক যেতে পারে। নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর বিপুল বিনিয়োগ যে সীমান্ত পরিস্থিতি মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু যাঁর নামে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে সেই ভূপেন হাজারিকা যুদ্ধ নয়, বরং শান্তির কথাই বলেছেন আজীবন গানে গানে। তবে আপাতত শান্তির সুযোগ কমে যাচ্ছে। লাদাখের পর প্রায় সব ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে চীনবিরোধী জাতীয়তাবাদী রণহুংকার প্রবল এক মাত্রা পেয়েছে। পুরো পরিস্থিতি আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতির জোর কমিয়ে দিয়েছে। লাদাখে সন্তানদের একতরফা মরতে দেখে ভারতীয়রা যে গভীর দুঃখ পেয়েছে, তার প্রবল চাপ তৈরি করেছে চীন-ভারত সব ফ্রন্টে। বিশেষ করে অরুণাচলে।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক