অমিত শাহ আক্ষরিক অর্থেই বৃষস্কন্ধ। বিজেপির এই সর্বভারতীয় সভাপতির রাজনৈতিক শক্তির মূল আধার যিনি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি নিজেই নিজের বুকের ছাতির মাপ জানাতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি, অমিত তাঁর চেয়েও বিপুলায়তন। বয়স তাঁর মাত্রই ৫১। কিন্তু দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা ও গাম্ভীর্য তাঁকে এমন করে তুলেছে, যাতে মনে হয় তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক গুরু সমবয়সী।
এই মানুষটির ঘাড়েই দলের দায়িত্ব দ্বিতীয়বারের মতো সঁপে দেওয়া হয়েছে। তিন বছর পর দেশ যখন আবার সাধারণ নির্বাচনের জন্য তৈরি হবে, তত দিন পর্যন্ত অমিত শাহই থাকবেন বিজেপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এই নির্বাচন সেই অর্থে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিজেপির গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী কোনো সভাপতি পরপর দুবারের বেশি (মেয়াদ তিন বছরের) পদে থাকতে পারবেন না। সেই ফরমান অনুযায়ী অমিত শাহকেও ২০১৯ সালের পর সরে যেতে হবে। অথচ অমিত একটানা ছয় বছর পদে থাকতে পারছেন না ভাঙা বছরে সভাপতি হওয়ায়। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে চমকপ্রদ সাফল্য এনে দেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি তো বটেই, গোটা দলই (আদভানি-জোশিদের মতো দলের বৃদ্ধ-ব্রিগেড বাদে) তাঁকে সভাপতি দেখতে ব্যাকুল হয়। ভোট পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন রাজনাথ সিং। নরেন্দ্র মোদি তাঁকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করায় সভাপতির আসন রাজনাথকে খালি করতে হয়। মোদি সেই শূন্যস্থানে অমিতকে বসিয়ে দেন। এর আগে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, বিজেপির এই ভারতজয়ের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন অমিত শাহ।
প্রবল স্রোতের মুখে খড়কুটো তো কোন ছার, বড় বড় পাথরও ভেসে যায়। মোদি-মাহাত্ম্যের রেশ ধরে সাধারণ নির্বাচনের পরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের ভালোমতো সাফল্য এমন একটা ধারণার জন্ম দেয়, যেন মোদি-শাহ জুটিই বিজেপি ও ভারতের ভবিতব্য। সেই ধারণা প্রথম ভালোমতো হোঁচট খায় দিল্লিতে। অজ্ঞাতকুলশীল অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর হামাগুড়ি দেওয়া দল আম আদমি পার্টির হাতে প্রবল পরাক্রম বিজেপিকে এভাবে হেনস্তা হতে হবে, দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারেনি। ৭০ আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি জেতে বিজেপি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করতে রাতারাতি যাঁকে আমদানি করা হয়, সেই কিরণ বেদিরও হেরে যাওয়া প্রকারান্তরে মোদি-শাহর মুখে কালি লেপে দেয়। কিন্তু তখনো তাঁরা বোঝেননি, আরও বেশি অপমান অপেক্ষায় আছে বিহারে।
বিহারে বিজেপির ভরাডুবি নিঃসীম শূন্যে উড়ন্ত বিজেপিকে আছড়ে ফেলে দেয় বাস্তবের রুক্ষ জমিতে। ভোটের ফল বেরোনোর আগে থেকেই একটা কথা চাউর হয়েছিল, বিহারে বিপর্যয় ঘটলে অমিত শাহকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে পাঠানো হবে। এই জল্পনার কিছুটা কারণও ছিল। গুজরাট থেকে নরেন্দ্র মোদির দিল্লি উত্তরণ রাজ্য রাজনীতিতে একটা শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আনন্দিবেনের পক্ষে সেই শূন্যতা ভরাট করা সম্ভব ছিল না। ইতিমধ্যে সংরক্ষণের দাবিতে রাজ্যের প্যাটেল সমাজে আলোড়ন তুলে দেন হার্দিক প্যাটেল নামে আরও এক অজ্ঞাতকুলশীল। ২৩ বছরের এই যুবক গোটা রাজ্যকে উত্তাল করে দেন। দিল্লি ও বিহারের বিপর্যয়ের দরুন অমিত শাহর নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্ন উঠে যাওয়ায় অনেকের ধারণা হয়েছিল, রাজ্য সামলাতে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে অমিত শাহকেই পাঠানো হবে গুজরাটে, দুই দিক সামাল দিতে। কিন্তু তা হলো না। অমিত শাহই দ্বিতীয়বারের জন্য দায়িত্ব পেলেন।
এ জন্য অমিত শাহ চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন নরেন্দ্র মোদির প্রতি। কেননা, শাহ ছাড়া মোদি আর কাউকে চিন্তায়ও আনেননি। মোদির সুরে না নেচে বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) উপায়ও ছিল না। কারণ, দলে দ্বিতীয় নেতৃত্ব হিসেবে দল ও সংঘ আর কাউকে তুলে ধরতে পারেনি।
অটল বিহারি বাজপেয়ি বরাবরই ছিলেন বিজেপির মুখ। তিনি সংগঠন করেননি কখনো। সাংগঠনিক দায়িত্ব যা কিছু পালন করার করেছিলেন লালকৃষ্ণ আদভানি। বিজেপিতে নেতা তৈরি কেউ যদি করে গিয়ে থাকেন, তা হলেন আদভানিই। প্রয়াত প্রমোদ মহাজন থেকে শুরু করে দলে আজ যাঁরাই কেউকেটা, সবাই আদভানির হাতে তৈরি। কার নাম করব? নরেন্দ্র মোদি? অরুণ জেটলি? সুষমা স্বরাজ? রাজনাথ সিং? ভেঙ্কাইয়া নাইডু? উমা ভারতী? শিবরাজ সিং চৌহান? বসুন্ধরা রাজে? বিজেপিতে পঞ্চাশ থেকে পঁয়ষট্টি—এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না, যাঁর রাজনৈতিক জীবন আদভানিকে কেন্দ্র করে পাক খায়নি। এখন এক অদ্ভুত খরা। নতুন নেতা কোথাও সেভাবে উঠে আসছেন না। মোদি একজনকেই তুলে এনেছেন। তিনি অমিত শাহ।
অমিত শাহকে একান্তই যদি সরাতে হতো, যদি তাঁকে গুজরাটে পাঠাতে হতো, কাকে তা হলে দায়িত্বে বসানো হতো, সেই চিন্তা বিজেপি যে করেনি তা নয়। কিন্তু তা করতে নেতৃত্বের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। আরএসএসেরও। দুটি নাম আলোচনার স্তরে উঠে এসেছিল। রাজস্থানের ওম মাথুর ও হিমাচল প্রদেশের জগৎ প্রকাশ নাড্ডা। কিন্তু দুজনের কেউই সর্বজনগ্রাহ্য নন। দলের নিয়ম হলো, এক ব্যক্তি এক পদ। ফলে মন্ত্রিসভার কাউকে যে ডবল দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেই গুড়েও বালি। দিল্লি ও বিহারের ধাক্কার ফলে নেতারাও এ কথা বুঝে গেছেন, পরের রাজ্যগুলো কঠিন ঠাঁই। ফলে মন্ত্রিত্ব ফেলে কেউ সংগঠনের কাঁটার মুকুট পরতে রাজি হননি। অমিত শাহর জন্য দ্বিতীয় দফার উত্তরণ তাই মসৃণ হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন হলো, পরবর্তী তিন বছর অমিত শাহ অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো বাধাহীন এগোতে পারবেন কি না। সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, কঠিন, খুবই কঠিন কাজ। আগামী তিন মাসের মধ্যে পাঁচ রাজ্যে ভোট। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়ু ও পদুচেরি। প্রতিটি রাজ্যই কঠিন ঠাঁই। পরের বছর পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশ। তার পরেই সাধারণ নির্বাচনের দামামা বেজে যাবে।
বিজেপির ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে এ বছরের পাঁচ রাজ্য বিধানসভার ভোট। এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে কেরালা, তামিলনাড়ু ও পদুচেরির কথা আলোচনা না করলেও চলবে। কেননা, ভোট চুকেবুকে গেলে দেখা যাবে, বিজেপি যে তিমিরে ছিল, হয়তো সেই তিমিরেই থেকে গেছে। এই কিছু মাস আগেও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে খুব তেড়েফুঁড়ে এগোতে চাইছিল। তাদের মনে এমন একটা ধারণা জন্মেছিল যে একটু চাপ দিলেই বোধ হয় মমতা-সাম্রাজ্য ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। সেই ভাবনা ও কল্পনা যে আকাশ–কুসুম, কিছুদিনের মধ্যেই তারা তা টের পেয়েছে। তবে মচকানো মানে খেলা শুরুর আগেই হেরে বসে যাওয়া। বিজেপি তা জানে। তাই রাজ্যে নেতাদের ভিড় তারা বাড়িয়েই চলেছে। তবে আরও পাঁচ বছর পর কী হবে, সেই জল্পনায় না গিয়ে বলা যায়, এবারের ভোটে রাজ্য দখলের দিবাস্বপ্ন বিজেপির না করাই ভালো। অঙ্কটা খুবই সহজ। ২০১১ সালে সিপিএমকে সরাতে রাজ্যে একটা রংধনু-জোট তৈরি হয়েছিল। এবার তা হচ্ছে না। কাজেই মমতা-রথ ড্যাং ড্যাং করে এগিয়ে যাবে।
এ বছর অমিত শাহ সবেধন নীলমণি। অতএব, শুধুই আসাম। আসামই তাঁর মাছের চোখ। কিন্তু সেখানেও জোর দিয়ে বলা যাবে না, শেষ পর্যন্ত বিজেপিই সরকার গড়বে। এটা ঠিক, ১৫ বছর ধরে কংগ্রেস আসামে একক ক্ষমতায় আসীন। ১৫ বছর ধরে তরুণ গগৈ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির কোনো অভিযোগও কেউ আনতে পারেনি। কিন্তু এটাও ঠিক, কংগ্রেসের ঘর ভেঙে তাদের প্রধান ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’ হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে বিজেপি বের করে এনেছে। ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে’ বড় করে তুলে ধরে তারা আসামে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বড়ো উপজাতিদের সঙ্গে তারা জোট বেঁধে নিয়েছে এবং চেষ্টা চালাচ্ছে ছোট ছোট অথচ খুবই সংঘবদ্ধ জনজাতিদের সঙ্গে জোট বাঁধার। অর্থাৎ, ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের ঢঙে আসামে কংগ্রেসবিরোধী একটা রংধনু জোট তৈরিতে বিজেপি আগ্রহ নিয়ে এগোচ্ছে। এ খেলায় অমিত শাহ যদি সফল হন, তাহলে বলা যেতেই পারে, আসামের লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে।
তবে একটা বড় ‘কিন্তু’ অমিত শাহর ঘাড়ের ব্যথা হিসেবে থাকছেই। বদরুদ্দিন আজমল। এই ‘আতর কিং’য়ের দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এআইইউডিএফ) রাজ্যে যে প্রভাব, তাতে নয় নয় করেও গোটা বিশেক আসন তারা পাবেই। ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আর যা–ই হোক, অমিত শাহর সঙ্গে তিনি যে হাত মেলাবেন না, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। বদরুদ্দিন আজমল কিছুদিন ধরেই জোটের হাত তরুণ গগৈয়ের দিকে বাড়িয়ে রেখেছেন। গগৈ সেই হাত ধরেননি। তাঁর আশঙ্কা, ভোটের আগে বদরুদ্দিন আজমলের সঙ্গে হাত মেলালে কংগ্রেসের মূল শক্তি অহমিয়া, হিন্দু বাঙালি এবং হিন্দু ও মুসলমান অহমিয়া ভোটে বিজেপি দাঁও মারতে পারে। অতএব, জোট যদি করতেই হয়, ভোটের পর, আগে নয়।
রাজীব গান্ধী আসাম চুক্তি করার পর ক্ষমতায় এসেছিল আসাম গণপরিষদ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন প্রফুল্ল মহন্ত। সেটা ছিল এক সুনামি। সেই দুর্দিনেও কংগ্রেস পেয়েছিল ২৫টি আসন। এবার রাজ্যে তেমন কোনো ঝড় নেই। তবু কংগ্রেসের যাবতীয় প্রতিরোধ ভেঙে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ মাধ্যমে অমিত শাহ আসাম লুট করলে সেটা হবে কিছুটা ফিকে হয়ে যাওয়া তাঁর পাগড়ির আরও একটা ঝলমলে পালক। বিজেপির আসাম দখল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই রাজ্যের সমাজ ও রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর তার প্রভাবও অস্বীকার করা যাবে না।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লীর প্রতিনিধি।