আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং দিবসটি পালনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়। এই দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য হলো, আদিবাসীদের জীবনধারা, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা এবং এই মানুষদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা।
২.
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী মানুষ বাস করে, যাদের ইনডিজিনাস পিপল, ফার্স্ট ন্যাশনস্, নেটিভ পিপল, অ্যাবোরিজিনাল, ট্রাইবাল, হিল পিপল ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। এ বছর জাতিসংঘ এই দিবসের মূল সুর ঠিক করেছে, ‘ইনডিজিনাস পিপলস মাইগ্রেশন অ্যান্ড মুভমেন্ট’। নানাভাবে এই মূল সুরের রূপান্তর করা যায়। আমরা জোর দিয়েছি আদিবাসী জাতিগুলোর দেশান্তরকরণ ও স্থানান্তরের ওপর।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতিসত্তার এই মানুষদের ইতিহাস জোরপূর্বক দেশান্তরকরণের ইতিহাস। বিশ্বের দেশে দেশে তারা নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। তাদের অঞ্চলে বহুবার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ি মানুষদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে দেশান্তরি হয়েছে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কখনো কখনো জমিজমা হারিয়ে, নিজস্ব টেরিটরি বা অঞ্চল হারিয়ে, সহায়–সম্পদ ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে পাহাড়ি মানুষ নিরাপত্তার সন্ধানে এবং ভবিষ্যৎ উন্নত জীবনের আশায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে।
বর্তমানে দেখা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের খোঁজে পাহাড়ি মানুষ তাদের গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। পরিবার–পরিজন নিয়ে শহরে নতুন পরিবেশে তারা সংগ্রাম করছে। নিজেদের অঞ্চলে নিরাপত্তার অভাব, জীবনের হুমকি, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানান চাপ ও অনিশ্চয়তার কারণেও তারা দেশান্তরি ও স্থানান্তরিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণেও তারা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও তারা দেশান্তরি হচ্ছে। নিজ অঞ্চলে বহিরাগত সেটেলারদের আধিপত্য ও অত্যাচারের কারণেও পাহাড়ের মানুষকে এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী এই প্রান্তিক মানুষদের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গারোরা দলে দলে শহরে এসে ভিড় করছে। এতে তাদের নিজস্ব জীবনধারা, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। লাতিন আমেরিকায় শতকরা ৪০ ভাগ ইনডিজিনাস পিপল এখন শহরে বাস করছে। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে এমনকি শতকরা ৮০ ভাগ ইনডিজিনাস পিপল বাস করে শহরে। যেসব সংখ্যাল্প জাতিসত্তার মানুষ নিজেদের অঞ্চল ছেড়ে ভালো থাকার আশায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা হতাশ হয়েছে। অন্যদিকে তারা নিজেদের বাড়িঘর-জমিজমা চিরতরে হারিয়েছে।
শুধু তা–ই নয়, নতুন অঞ্চলে, নতুন পরিবেশে এই মানুষেরা নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সামাজিক সেবা ও অন্যান্য খাতে তারা কখনো কখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যেসব পাহাড়ি মানুষ ট্রান্স-বর্ডার অঞ্চলে বসবাস করছে, তাদের ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বা বন্ধন ছিন্ন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
৩.
বাংলাদেশের জন্যও জাতিসংঘের এ বছরের মূল সুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বাংলাদেশে পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের ইতিহাস নিজভূমি থেকে উচ্ছেদের ইতিহাস, জোরপূর্বক দেশান্তরের ইতিহাস, নির্মম দেশান্তরকরণের ইতিহাস। এখানে ১৯৪৭ সালের পর বারবার পাহাড়ি জনগণকে দেশান্তরি হতে বাধ্য করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, উত্তরবঙ্গ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী জনগণ দেশান্তরি হয়েছে।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে লক্ষাধিক পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদের শিকার হয় এবং তাদের মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক পাহাড়ি মানুষ ভারত ও মিয়ানমারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সেখানে এই আদিবাসী মানুষেরা পরিণত হয় দেশহীন নাগরিক হিসেবে। দেশভাগের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে শতকরা ৭৫ ভাগ গারো জন্মভূমি ত্যাগ করে ভারতের মেঘালয় ও আসামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অন্যান্য সংখ্যাল্প জাতির মধ্যে হাজং, কোচ, বানাই, হদি, ডালু ইত্যাদি জাতির শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তারা তাদের বাড়িঘর, জমি, ভিটামাটি চিরতরে হারায়।
উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ও অন্যদের অবস্থা আরও শোচনীয়। জমিজমা হারিয়ে উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও ও মুন্ডারা এখন নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও এই মানুষদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ ও অত্যাচারের অবসান হয়নি। এখনো অনেকে নীরবে দেশ ত্যাগ করছে।
এই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা রাষ্ট্রে এতটাই উপেক্ষিত যে এই দেশান্তরের ইতিহাসও জানা যায় না, এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয় না। এ নিয়ে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া অনেকটাই নীরব অথবা উদাসীন। দেশে কিছু কিছু জাতিসত্তার পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তপ্রায়। কোনো কোনো জাতি কোনোরকমে টিকে আছে।
এককালের প্রভাবশালী হাজং জাতি এখন অদৃশ্যপ্রায়। অনেকেই ভারতে চলে গেছে। একসময় বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় ৫০ হাজারের অধিক রাখাইন বসতি ছিল, দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, সেখানে বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে নেমে উল্টো মাত্র ২ হাজার ২০০। অনেকেই দেশান্তরি হয়েছে অথবা অন্যত্র চলে গেছে নিরাপত্তার কারণে। আগামী কয়েক দশক পর এই অঞ্চলে রাখাইনের অস্তিত্ব হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে।
৪.
কেন মানুষ দেশান্তরি হয়? স্বেচ্ছায় জন্মভূমি ছেড়ে কেউ কি চলে যেতে চায়? জন্মভূমি হলো মায়ের মতো। তারপরও পাহাড়ি মানুষকে কেন প্রিয় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়? আমরা কি ওই রাষ্ট্র পেয়েছি, যেমন চেয়েছিলাম একাত্তরে? বৈষম্যহীন, কল্যাণকর, গণতান্ত্রিক ও মানবিক একটি রাষ্ট্র? রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার পাহাড়ি মানুষ এখন এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বাস করছে। চট্টগ্রাম ও সাভার ইপিজেড অঞ্চলে হাজারে হাজারে কাজ করছে। গারো, সাঁওতালসহ অন্যরাও ব্যাপক হারে শহরমুখী হয়েছে। তাদের এই স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুশ ফ্যাক্টর ও পুল ফ্যাক্টর উভয়ই কাজ করেছে।
নিজেদের অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে নিরাপত্তাহীনতাসহ অর্থনৈতিক, সামাজিক সংকটে জর্জরিত হচ্ছে। এখনো কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উন্নত বাসস্থানসহ নানা চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান ওদের অঞ্চলগুলোতে। আবার যেসব শিক্ষিত পাহাড়ি মানুষ স্বেচ্ছায় উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছে, তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় এটি বলা যায় যে ‘মাইগ্রেশন’ পাহাড়ি মানুষের জীবনে তেমন ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারেনি।
৫.
আজ আদিবাসী জনগণ নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি চায়। কিন্তু ওদের অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও নিয়ন্ত্রণহীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে তারা নিজ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, হুমকি, নারী নির্যাতন, ভূমি দখল, অপমান ও লাঞ্ছনার কারণে দেশান্তরের প্রবণতা বাড়ছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার পরও কোনো বিচার না হওয়ায় অনেকে নীরবে অন্যত্র চলে গেছে। মধুপুর গড় অঞ্চলের ২০ হাজারের অধিক গারো, কোচ ও বর্মণ রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজিতে জাতিসংঘ ইনডিজিনাস পিপলসহ বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলেছে, যার মূল কথা ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’। যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা চলবে না’।
এ কথাটি যেন সবার বেলায় সত্য হয়।
সঞ্জীব দ্রং সংস্কৃতিকর্মী ও কলাম লেখক