অভিন্ন অর্থনীতিতে জীবনমান ভিন্ন কেন

সাড়ে তিন শ কোটি লোক দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের বেশি কামাই করার পরও দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে আছে। ছবি: রয়টার্স
সাড়ে তিন শ কোটি লোক দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের বেশি কামাই করার পরও দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে আছে। ছবি: রয়টার্স

বছরের পর বছর বিল গেটস থেকে জিম কিম, নিক ক্রিস্টোফ থেকে স্টিভেন পিংকার—আন্তর্জাতিক উন্নয়নের তারকা হিসেবে পরিচিত এসব মহান ব্যক্তির মুখ থেকে আমরা শুনে আসছি বৈশ্বিক দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে অপূর্ব অগ্রগতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, ১৯৯০ সালে যেখানে বিশ্বের ১৯০ কোটি মানুষের দৈনিক গড় আয় ছিল ১ দশমিক ৯০ ডলার (ডলারের সর্বশেষ মূল্যমান অনুযায়ী, বাংলাদেশি টাকায় ১৬১ টাকা ১১ পয়সা), সেখানে ২০১৫ সালে ‘মাত্র’ ৭৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এ পরিমাণ অর্থ আয় করছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, বিপুলসংখ্যক মানুষের দৈনন্দিন গড় আয় বেড়েছে।

প্রথম ঝটকায় বিষয়টিকে সুসংবাদ বলে মনে হবে। কিন্তু গভীরে গেলেই শুভংকরের ফাঁকি ধরা পড়বে। প্রথমত ১ দশমিক ৯০ ডলার উপার্জনকে দারিদ্র্য সীমারেখা হিসেবে ধরার মধ্যে কোনো অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ভিত্তি নেই। আদতে একটা লোক দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলার আয় করে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারবে না। এ অর্থে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণ একেবারে অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে সাড়ে তিন শ কোটি লোক দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের বেশি কামাই করার পরও দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে আছে।

আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য সীমারেখা নির্ধারণ করতে হলে নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রধান বিষয় হিসেবে ধরতে হবে—সবার আগে এটি মেনে নেওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নির্ধারকেরা কেন দারিদ্র্য সীমারেখা হিসেবে দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারকে বেঁধে দিলেন, যেখানে বিশ্বব্যাংকের মতেই পশ্চিমা সমাজে এ পরিমাণ অর্থ উপার্জনকারী দারিদ্র্যসীমার চেয়ে বহু নিচে। যেমন গরিব দেশের মানুষের জন্য দারিদ্র্যসীমা ১ দশমিক ৯০ ডলার ধরলেও যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্যসীমা হিসেবে দৈনিক গড় আয় ধরা হয়েছে ১৫ ডলার। অর্থাৎ পরিষ্কারভাবেই এটি দ্বৈত নীতির প্রতিফলন ও বর্ণবাদী বিচার। পৃথিবীর উত্তর অঞ্চলের (যেখানে শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগরিষ্ঠ) মানুষের জন্য একধরনের জীবনমান ধরা হচ্ছে এবং অশ্বেতাঙ্গ–প্রধান দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জন্য আরেক ধরনের মান নির্ধারণ করা হচ্ছে।

অনেকে যুক্তি দেখিয়ে বলবেন, এগুলো একেবারে আলাদা ধরনের অর্থনীতি এবং সে কারণেই আলাদাভাবে মান নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এভাবে ভাগ করার আইডিয়া মোটেও সমীচীন নয়। কারণ, পাঁচ শ বছর ধরে উত্তর এবং দক্ষিণের অর্থনীতি একটি অভিন্ন বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থেকে এসেছে।

আমরা ভালো করে জানি, উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে উপনিবেশ আমলের সস্তা শ্রম ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে তোলা খনিজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। আন্দিজ পর্বতমালার আশপাশের দেশ থেকে চুরি করে আনা রৌপ্য, কঙ্গো থেকে আনা রাবার, ভারতবর্ষ থেকে আনা খাদ্যশস্য এবং আফ্রিকান দাসদের দিয়ে জোর করে উৎপাদন করা চিনি ও তুলা থেকে উত্তর যুক্তরাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়েছে।

মনে হতে পারে এসব আদিকালের কথা। কিন্তু না। সেই একই অবস্থা আজও টিকে আছে। তবে ভিন্ন চেহারায়। বিশ্বের উত্তর প্রান্তে বসে স্টিভেন পিংকার (কানাডিয়ান-আমেরিকান বুদ্ধিজীবী) যে জামাটি গায়ে দিচ্ছেন, তা সেলাই হয়ে আসছে দক্ষিণের কোনো অনুন্নত দেশ থেকে। লেখক বিল ক্রিস্টোফ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের কোম্পানির যে ল্যাপটপ দিয়ে লিখছেন, সেটি অ্যাসেম্বেল করছেন সেই দক্ষিণেরই মানুষ। জিম কিম যে কলা ও বেরি দিয়ে সকালে নাশতা করছেন, তা উৎপাদিত হচ্ছে সেই দক্ষিণেই। এমনিভাবে চা, কফি, আমাদের কারখানাগুলো চালানো জ্বালানি, ইলেকট্রিক কার বানানোর লিথিয়াম—এ সবকিছুর উৎসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে আমরা একটি অভিন্ন বৈশ্বিক অর্থনীতির আওতায় আছি, আলাদা অর্থনীতিতে নয়।

দক্ষিণের দরিদ্র মানুষগুলো যেইমাত্র এক ডলারের জায়গায় দুই ডলার আয় করে বসে, তখনই বিল গেটস ও পিংকাররা আমাদের সেই খবরকে উদ্‌যাপন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডের কোম্পানিতে চাকরি করে উত্তরের কোনো শ্রমিক দিনে দুই ডলার আয় করছেন শুনে আমরা কি তা উদ্‌যাপন করতে পারব? না, পারব না। কারণ, তাদের জন্য আলাদা জীবনমান ধরা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় একসময় একই কাজের জন্য শ্বেতাঙ্গদের বেশি মজুরি এবং কৃষ্ণাঙ্গদের কম মজুরি দেওয়া হতো। শাসকেরা বলতেন, কালোদের কাজের মান কম। সে কারণে তঁাদের মজুরি কম। সেটি এখন অলিখিতভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন, দক্ষিণের শ্রমিকদের উৎপাদন মান খারাপ, এ কারণে তাঁদের মজুরি কম। এটি ভুল কথা। তাঁদের মনে রাখা উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই এসব শ্রমিক অভিন্ন কোম্পানিতে অভিন্ন প্রযুক্তি সহায়তায় কাজ করেন। যেমন মেক্সিকোয় জেনারেল মোটর ফ্যাক্টরি ও বাংলাদেশে নাইকির কারখানায় যে পণ্য উৎপাদিত হয়, তা বিশ্বমানের।

উপনিবেশের সুদীর্ঘ ধারা থেকেই ১ দশমিক ৯০ ডলারকে দারিদ্র্য সীমারেখা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই একুশ শতকে আমরা যখন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বলে স্লোগান তুলছি, তখন এটিই বাস্তব হয়ে আমাদের সামনে হাজির রয়েছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জন হাইকেল: ব্রিটিশ লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের শিক্ষক