একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে রাজশাহী থেকে দুঃসাহসিকভাবে জয় বাংলা পত্রিকা ছেপে বের করছিলেন মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ। নিজেই ছিলেন সম্পাদক। পুনর্মুদ্রিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (খণ্ড: ১৫) থেকে
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতের নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ ঘটনাবলির খবর ঘটনার দু-এক দিনের মধ্যেই টুকরো টুকরোভাবে বিভিন্ন সূত্রে নওগাঁতেও এসে পৌঁছেছিল। অনেকের মতো আমারও কোনো সন্দেহ ছিল না যে ওই ঘটনা আমাদের এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাসংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছে।
ঢাকা শত্রুকবলিত হওয়ায় ঢাকার সংবাদপত্রগুলো আর ‘আমাদের’ ছিল না। ওগুলো দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচারপত্রে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামের সপক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য আমাদেরও পত্রপত্রিকার প্রয়োজন রয়েছে মনে করেই প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশেও রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমা শহরের হোটেল পট্টির পাশে কাজীপাড়ার ছোট একটি হস্তচালিত প্রেস থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ক্ষুদ্রাকৃতি এক পাতার দৈনিক জয় বাংলা বের করি। বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত ‘জয় বাংলা’ কথাটি আমাদের জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছিল বলে আমার পত্রিকার নামটিও জয় বাংলা রাখি।
লেখা, রিপোর্ট সংগ্রহ, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণের ব্যবস্থা আমিই করতাম। সম্পাদকীয় মন্তব্য ও বিভিন্ন রিপোর্ট আমি সাধারণত রাতে ও খুব ভোরে লিখতাম। তারপর প্রায় সারা দিন প্রেসে বসে হাত-কম্পোজ শেষে প্রুফ দেখে ছাপা হওয়ার পর বিকেলে পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে প্রেস থেকে বের হতাম। মুসলিম লীগের সাবেক এমপিএ কাজী শাহ মাহমুদের মালিকানাধীন প্রেসের ওপর যাতে কোনো বিপদ না আসে, সে কারণে কাজী সাহেবের অনুরোধে পত্রিকায় প্রেসের নাম ছাপা হতো না। প্রেসের ম্যানেজার ও কম্পোজিটর যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে কাজ করতেন।
২৬ মার্চ থেকেই আমরা নিজেদের স্বাধীন হিসেবে গণ্য করছিলাম। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কোনো সরকার গঠিত না হলেও এক ‘গোপন সরকারের’ অস্তিত্ব স্বীকার করে সংগ্রাম পরিষদগুলোকে স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করার জন্য জয় বাংলার প্রথম সংখ্যাতেই মত প্রকাশ করা হয়।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত অপর কোনো দৈনিক পত্রিকার অস্তিত্বের কথা আমাদের জানা ছিল না, সে কারণে জয় বাংলার নামের ওপরে ‘স্বাধীন বাংলার একমাত্র মুখপত্র’ কথাটি ছাপা হতো।
জয় বাংলা প্রথম থেকেই কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হুমকি, এমনকি সম্পাদকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি হুমকিরও তোয়াক্কা না করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা এবং সব ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
৫ এপ্রিল রাতে আমি রাইফেল বাহিনীর (ইপিআর) গোলাবারুদের জিপে চড়ে বগুড়া যাই। বগুড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও মুক্তাঞ্চল সফর শেষে ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় নওগাঁ ফিরে আসি। এ কারণে ৬ ও ৭ এপ্রিল দুদিন জয় বাংলা প্রকাশিত হয়নি। ৮ এপ্রিল বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে অষ্টম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়।
বিশেষ এ সংখ্যাটিতে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বগুড়া শহরকে রক্ষা এবং মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আড়িয়ার বাজারে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনীর গোলাবারুদের ডিপো দখলের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়। এ ছাড়া মুক্তাঞ্চলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোর কর্মীদের সহায়তায় যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার কথাও লেখা হয়।
জয় বাংলার একাদশ ও শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১। সেই সংখ্যায় যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য ‘জবাসস’ (জয় বাংলা সংবাদ সংস্থা) গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে যেসব খবর পাচ্ছিলাম সেগুলো একটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই এটি গঠন করি। আমাদের কোনো নিজস্ব সংবাদ সংস্থা ছিল না এবং কেউ সে রকম কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সীমিত সামর্থ্য নিয়েই জবাসস গঠন করি।
মুক্তাঞ্চলের কিছু টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। এই কাজে সহায়তা করেন নওগাঁ এক্সচেঞ্জের অপারেটর বজলুর রহমান, সলিম মণ্ডল, পাঁচবিবি এক্সচেঞ্জের শ্রী উপেন্দ্রনাথ ঘোষসহ আরও অনেকে। বগুড়া সার্কিট হাউসের মুক্তিযোদ্ধা কন্ট্রোল রুমের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার দবিরউদ্দীন (ওস্তাদজি) ও হাবিলদার এমদাদুল হক ওরফে তোতাও এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। এ ছাড়া রাইফেল বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার মেজর নজমুল হকও এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন।
দেশের অন্যান্য সীমান্তের মতো নওগাঁ সীমান্তও তখন উন্মুক্ত ছিল। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকারও দু-এক কপি সীমান্তপথে আমাদের হাতে আসতে শুরু করেছিল। জয় বাংলার একাদশ সংখ্যায় ‘জবাসস’ সংগৃহীত এবং এসব পত্রপত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করে কিছু সংবাদ ছাপানো হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার ৯ এপ্রিল তারিখের সংবাদে জানতে পারি যে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপল-এর কার্যালয়গুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং বেশ কিছু সাংবাদিক ও কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছে। আরও জানতে পারি যে দ্য পাকিস্তান অবজারভার, দ্য মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ ও পূর্বদেশ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাপা হচ্ছে। জয় বাংলায় এ খবর উদ্ধৃত করে মন্তব্য করা হয়, ‘পশ্চিমা বর্বরেরা বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য উক্ত বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর নাম বা গুডউইল ব্যবহার করিতেছে।’ এই সংখ্যায় জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলোর অফিস ধ্বংস ও সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করা হয়।
হানাদারদের আক্রমণের ভয়ে নওগাঁ শহর তখন প্রায় ফাঁকা। কাজীপাড়ার যে ছোট প্রেস থেকে জয় বাংলা ছাপা হচ্ছিল তার কর্মচারীদের অনেক বলেকয়েও নওগাঁ থাকতে রাজি করানো যাচ্ছিল না। সবার মনেই ভীতি—এই বুঝি হানাদারেরা এসে পড়ে।
অন্যান্য প্রেসও বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে জয় বাংলা আর ছাপানো সম্ভব হয়নি।নিজস্ব সীমিত পুঁজির ওপর নির্ভর করেই জয় বাংলা প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছিলাম। কারও কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। প্রেস কর্তৃপক্ষও কোনো লাভ নিতেন না, শুধু কাগজ ও মুদ্রণের খরচ নিতেন। জয় বাংলার প্রথম সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা ধার্য হয়েছিল। এক ঘণ্টায় ২০০ কপি বিক্রিও হয়েছিল। কিন্তু এই সামান্য দাম আদায়ে ঝামেলার কারণে প্রথম সংখ্যার অবশিষ্ট কপি ও দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যার সব কপিই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
জয় বাংলার প্রথম সংখ্যাটি ছাপা হয়েছিল এক হাজার কপি। পরের সংখ্যাগুলোর কোনোটা আড়াই হাজার, কোনোটা তিন হাজার কপি ছাপা হয়। সর্বমোট কপির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। খুলনা নিউজপ্রিন্টের হাফ ডিমাই সাইজের কাগজে জয় বাংলা ছাপানো হতো। প্রথম কয়েক সংখ্যা এক পাতার এক পাশে এবং অবশিষ্টগুলো এক পাতার দুই পাশে ছাপা হতো। ওই পরিস্থিতিতে ছোট হাতে চালানো প্রেস থেকে এর চেয়ে বড় আকারে পত্রিকা বের করা কোনোমতেই সম্ভব ছিল না।
জয় বাংলার প্রথম সংখ্যাটি আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী জাহিদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজে নওগাঁ শহরে বিলি করেছিলাম ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চে। এই পত্রিকা প্রকাশকালে নওগাঁর তৎকালীন এমএনএ বায়তুল্লাহ (পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার), নওগাঁ, রাজশাহী ও বগুড়া মুক্তাঞ্চলের তৎকালীন কমান্ডার রাইফেল বাহিনীর (ইপিআর) মেজর নাজমুল হক, বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের আরও অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। মেজর হকের অনুমতিক্রমেই তাঁর বাহিনীর যানবাহনে নওগাঁর বাইরে জয় বাংলার বান্ডিল পাঠানো সম্ভব হয়।
১৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সংগ্রাম পরিষদের অফিসেও আর কাউকে পাওয়া গেল না। সবাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। মুক্তি সিনেমা হলের রাস্তার মাথার টেলিফোন এক্সচেঞ্জটিতে তখনো একজন অপারেটর ছিলেন। সেখান থেকে রাতে বলিহার হাউসের রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে ফোন করে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এ পরিস্থিতিতে আমি অপারেটরের সহায়তায় পাঁচবিবি, আত্রাই, জয়পুরহাট, ও পত্নীতলা পিসিও ও বগুড়া সার্কিট হাউসে অবস্থিত বগুড়া কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং রাজশাহীর সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিই। নওগাঁর পরিস্থিতিরও ইঙ্গিত দিই।
পরদিন ১৫ এপ্রিল সকালে হেডকোয়ার্টার শূন্য থাকার খবর পাওয়া গেল। আগের রাতেই রাইফেল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শহরও প্রায় জনশূন্য। প্রেসও বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে আমার শহরে থাকা মানে হানাদারদের হাতে খামোখা জান দেওয়া। একটি ব্যাগে কাগজপত্র ও এক সেট বাড়তি কাপড় নিয়ে আমার বাসা কাম জয় বাংলার দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।
মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ: ১৯৭১ সালে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদক।