মামলা প্রত্যাহার হয়নি, রোজিনা ইসলাম জামিনে ছাড়া পেয়েছেন শুধু। তবু এ খবর গণমাধ্যমের কাছে বসন্তসমীরণের মতো তৃপ্তিদায়ক। মনে হচ্ছে এই যেন ঢের পাওনা। কদিন ধরে বাংলাদেশের আনাচকানাচে তো বটেই, পড়শি দেশেও রোজিনা-বিড়ম্বনা আগ্রহ বাড়িয়েছে। তাঁর জামিন সেই অর্থে সংবাদমাধ্যমেরও জয়। যদিও মামলার শেষ কবে ও কীভাবে হবে, অজানা।
সাংবাদিকের ওপর বাংলাদেশে ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ (ওএসএ)–এর শেষ প্রয়োগ কবে হয়েছিল, গবেষণাযোগ্য। প্রতিবেশী ভারত কিন্তু সেই রোগমুক্ত নয়। সে দেশে শেষ হুমকিটা শোনা গিয়েছিল দুই বছর আগে, যখন ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান কেনাবেচা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন দ্য হিন্দু পত্রিকা গোষ্ঠীর কর্ণধার এন রাম। সুপ্রিম কোর্টে রাফালসংক্রান্ত মামলায় ২০১৯ সালের মার্চ মাসে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল বলেছিলেন, দ্য হিন্দুর বিরুদ্ধে সরকার ওএসএ প্রয়োগ করতে পারে।
হুমকিতে এন রাম দমেননি। বলেছিলেন, রাফাল নিয়ে প্রকাশিত সব তথ্যই বৈধ ও ন্যায্য। এ কথাও বলেছিলেন, কোনোভাবেই খবরের ‘সোর্স’ জানাবেন না। ভারতের এডিটরস গিল্ড অ্যাটর্নি জেনারেলের হুমকির বিরোধিতা করে বলেছিল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ওই আইনের প্রয়োগ হবে অতীব নিন্দনীয়। একই রকম প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশের গণমাধ্যম। রোজিনার গ্রেপ্তারি এই পেশার মানুষকে অদ্ভুতভাবে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
রামের বিরুদ্ধে ওএসএর প্রয়োগ হয়নি, যদিও তাঁর মতো ভাগ্যবান ছিলেন না কাশ্মীরি সাংবাদিক ইফতিকার গিলানি। ২০০২ সালের জুন মাসে গিলানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওএসএ প্রয়োগ করা হয়। অভিযোগ, তিনি গোপন নথি পাচারের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় দুই বছর গিলানির বিরুদ্ধে তদন্ত চলেছিল। কিন্তু ‘গোপন’ নথি পাচার প্রমাণিত হয়নি। সেনাবাহিনীও জানিয়েছিল, গিলানির বিরুদ্ধে যেসব তথ্য হাতানোর অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো সহজলভ্য। গোপন ও নিরাপত্তা বিঘ্নিতকারী নয়।
বাংলাদেশের অবস্থা প্রতিবেশীর সঙ্গে অবশ্যই তুলনীয় নয়। রোজিনা অধ্যায় সেই হিসেবে ব্যতিক্রম। যদিও ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ওই আইন দেশভাগ সত্ত্বেও তিন দেশেই বিদ্যমান এবং তার রক্তচক্ষু নিবদ্ধ অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিককুলের ওপর
কিন্তু তত দিনে কেটে গেছে দুটি বছর। গিলানি ও তাঁর পরিবারকে পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্দশা। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে সরকার মামলা প্রত্যাহার করে। গিলানি মুক্তি ও সম্মান ফিরে পান।
রোজিনার ক্ষেত্রে কী হবে, ভবিষ্যৎ সেই উত্তর দেবে।
সাংবাদিক শান্তনু শইকিয়াও ছিলেন দুর্ভাগা। দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় শান্তনু এক ‘ক্যাবিনেট নোট’ প্রকাশ করেছিলেন, যার ওপরে ‘সিক্রেট’ শব্দটি লেখা ছিল। আদালত তাতে বলেছিলেন, নথির ওপর ‘সিক্রেট’ লেখার অর্থ এই নয় যে তা প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ওএসএ প্রয়োগ করতে হবে। সেই শান্তনুকে ২০১৫ সালে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে অন্য এক মামলায়। অভিযোগ সরকারি নথি ‘চুরির’। ৮০ দিন পর শান্তনু জামিন পেয়েছিলেন। তবে তার আগে বিচারক ইন্দ্রজিৎ সিং বলেছিলেন, কোনো সরকারি ‘কোড’ বা ‘পাসওয়ার্ড’ প্রকাশ করা হয়েছে কি না, তার ওপরেই গোপনীয়তা ভাঙার বিষয়টি নির্ভরশীল। ‘সিক্রেট’ লেখা থাকলেই তা ‘গোপন’ হয় না।
শান্তনু শইকিয়া ওএসএ আইন বাতিলের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। আইন যদিও বহাল। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা হংসরাজ আহির সংসদকে জানান, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে দায়ের হয়েছে ৩০টি, ২০১৫ সালে ৯টি এবং ২০১৪–তে ১১টি।
এই আইনের ছোবল থেকে রেহাই পাননি ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান বর্তমানে বিজেপির নেতা ও মন্ত্রী বিজয় কুমার (ভি কে) সিংও। অবসর গ্রহণের দুই বছর পর ২০০৭ সালে ইন্ডিয়াজ এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স: সিক্রেটস অব আরএডব্লিউ বইটি প্রকাশের পর তাঁর বিরুদ্ধে ওএসএ লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। তাঁর বাড়িও তল্লাশি চালানো হয় বলে খবর। ২০০৯ সালে ‘দ্য ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া’য় তিনি ‘দ্য অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩—আ ট্রাবল্ড লেগ্যাসি’ শিরোনামে এক নিবন্ধ লেখেন। তাতে এই আইনকে ‘কালাকানুন’ অভিহিত করে লিখেছিলেন, ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান বীরাপ্পা মইলি এই আইন বাতিলের সুপারিশ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপত্তি জানিয়েছিল। এই আইনে নির্দোষ মানুষকে বেশি সাজা ভোগ করতে হয়েছে। অথচ গুপ্তচরদের সাজা পাওয়ার ঘটনা বিরল। আইন অপব্যবহারের ঘটনাও ভূরি ভূরি। ইতিহাসের ডাস্টবিনে এই আইনকে ছুড়ে ফেলার এই কি উপযুক্ত সময় নয়?’ সাবেক সেনাপ্রধান এ কথাও লিখেছিলেন, ২০০৫ সালে তথ্য জানার অধিকার আইন প্রণয়নের পর ওএসএ রেখে দেওয়া অর্থহীন।
সাবেক সেনাপ্রধান এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ওএসএ বাতিল ও অপব্যবহার নিয়ে এখন তিনি মৌন।
তথ্য জানার অধিকার আন্দোলনের কর্মী কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ দেবপ্রসাদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওএসও টিকিয়ে রাখা অর্থহীন। বিশেষ করে তথ্য জানার অধিকার আইন (আরটিআই) প্রণয়নের পর। কিন্তু সত্য হলো আইন বাতিলে কোনো সরকারই আগ্রহী নয়। সে ক্ষেত্রে ওই আইনে নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, প্রতিরক্ষা, আন্তরাজ্য সম্পর্কসহ যে সাতটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর বাইরে অন্য কোনো ক্ষেত্রে এই আইনের অপব্যবহার হওয়া উচিত নয়।’ তিনি বলেন, ‘এই আইন অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরাই এই উপমহাদেশে সফট টার্গেট। সেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা গেল।’
অমর্ত্য সেন প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের ন্যাশনাল রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ও আরটিআই আন্দোলনের কর্মী সাবির আহমেদের মতে, ‘তথ্য জানার অধিকার আইনের বিস্তার যত হবে, ওএসএ-ও তত সংকুচিত হবে। আইনের যৌক্তিকতাই থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র দিন দিন তথ্য জানার অধিকারকেই খর্ব করছে। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা খুন হচ্ছেন। কালাকানুনের প্রয়োগও বেড়ে যাচ্ছে।’ দেবপ্রসাদ রায় ও সাবির আহমেদ দুজনেই বলেন, ওএসএর লক্ষ্য গুপ্তচরবৃত্তি ঠেকানো। কিন্তু কোনো দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হয় না। বৈদেশিক শত্রুর হাতও শক্ত হয় না।
বাংলাদেশের অবস্থা প্রতিবেশীর সঙ্গে অবশ্যই তুলনীয় নয়। রোজিনা অধ্যায় সেই হিসেবে ব্যতিক্রম। যদিও ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ওই আইন দেশভাগ সত্ত্বেও তিন দেশেই বিদ্যমান এবং তার রক্তচক্ষু নিবদ্ধ অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিককুলের ওপর।
● সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি