বেশ ঘটা করে মার্চ মাসে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই এখন আলোর নিচে অন্ধকার। আবারও লোডশেডিংয়ের জাঁতাকলে পড়েছে সারা দেশ। দেশের কোথাও কোথাও ৭–৮ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। প্রতিবার ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট করে বিদ্যুৎ থাকছে না। ঈদের আগে আগে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট জনজীবনে নতুন ভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ সময় দেশে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট ছিল না। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
১০ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অপখরচের কারণে এই সংকট অনেকটাই অনিবার্য ছিল। বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গত ১০ বছরে শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে, এর জন্য সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে আগেও ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন অর্থ লুটপাটের এক সহজ উপায়ে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এই খাতে যন্ত্রপাতি আমদানির নামে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। তাই প্রশ্নটা অনিবার্য ছিল—কখন সংকটের শুরু হবে। সরকার স্বীকার না করলেও বলা যায় ডলার–সংকটের কারণে বিদ্যুৎ খাতে এই সংকট শুরু হয়েছে।
শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই সংকট অন্যান্য খাতে সংক্রমিত হতে পারে। সরকার সামাল দিতে পারলে ভালো। নতুবা পরিস্থিতি খুব বেশি সুখকর না–ও হতে পারে। প্রশ্ন হলো জ্বালানির এই বাড়তি দাম দেওয়ার মতো অর্থ কি সরকারের হাতে নেই। দাম বেশি বলে তো জীবন আর থেমে থাকবে না। সবাইকেই এই দাম দিয়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাস কিনতে হবে। একদিকে ব্যবহার কমিয়ে, অন্যদিকে খরচ কমিয়ে তা করতে হবে। বিভিন্ন দেশ এভাবেই চলছে। কিন্তু আমরা অন্যদিকে বেশি খরচ করে ফেলায় এখন আমাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে সরকারি হিসাবে গরমিল আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, মে মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রকৃত মজুতের পরিমাণ হচ্ছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের অধীন রপ্তানিকারকদের ঋণ দিয়েছে। এই ৭ বিলিয়ন ডলার সরকার মোট মজুত অর্থের সঙ্গে হিসাব করে। কিন্তু বাস্তবে এই টাকা সরকারের হাতে নেই। সম্ভবত এ টাকাও বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারে। আর ৩৪ বিলিয়ন ডলার আপাতত নিরাপদ মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতির কারণে এই পরিমাণ মজুতও পর্যাপ্ত নয়।
বাংলাদেশে রিজার্ভের বড় উৎস প্রবাসী আয়। কোরবানির ঈদের আগে প্রবাসী আয় কিছুটা বাড়লেও মে মাসে প্রবাসী আয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১৩ শতাংশ প্রবাসী আয় কমছে মে মাসে। এ সময় ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার প্রবাসীদের আয় হিসাবে দেশে এসেছে। এপ্রিলে এসেছিল ২০১ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২১ সালের এপ্রিলে এসেছিল ২১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছর থেকেই বিরতি দিয়ে দিয়ে প্রবাসী আয় কমেছে। প্রণোদনার শর্ত শিথিল করেও আয় বাড়াতে পারছে না সরকার।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার মতো অবস্থাও সরকারের নেই। তাই জ্বালানি আমদানিতে ভাটা পড়েছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি দিতে পারছে না। অথচ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গত ১০ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে সরকার। অপখরচ, পাচার এবং অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব বিদ্যুৎ খাতের ওপরে কিছুটা পড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া ও প্রবাসী আয়ে টান ধরায় দেশে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই সরকার মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে বিদ্যুৎ খাতের সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের তথ্য একাংশে সঠিক। উচ্চমূল্য দিয়ে জ্বালানি কেনা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, জ্বালানির উচ্চমূল্য পরিশোধ করলে রিজার্ভের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এটা ঠিক, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। কিন্তু এ সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে নানা খাতে অপখরচ হয়েছে। বাস্তবায়ন করা হয়েছে অনেক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। এর অন্যতম খাত হচ্ছে বিদ্যুৎ। সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতার বেশি উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে আমরা বসে আছি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুসারে, দেশের বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। ক্যাপটিভ পাওয়ার বিবেচনায় নিলে উৎপাদনক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বা ১১ হাজার ৩৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্যাসচালিত কেন্দ্রে উৎপাদিত হয়। ৭ ভাগ বিদ্যুৎ আসে কয়লানির্ভর কেন্দ্র থেকে। নবায়নজোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হয় ২২৯ মেগাওয়াট। আর ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আর জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ বা ৭ হাজার ৮২২ মেগাওয়াট। ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনই গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর। সরকার পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। এখন সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ১৫২টি। জ্বালানির অভাবে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট কমে গেছে। অতিমাত্রায় গ্যাসনির্ভর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুসারে, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আসে ২২০-২৩০ ঘনফুট। ৭০ থেকে ৮০ ঘনফুট আমদানি করা হয় এলএনজি হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ ঘনফুটের বেশি সরকার দিতে পারছে না। এই গ্যাস আবার শিল্প খাত ও বিদ্যুৎ খাতে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়।
ওদিকে বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪১ ডলারের কাছাকাছি। কোভিডের আগে দাম ছিল ৪ ডলার। তেলের দাম ছিল ৭৭ ডলার প্রতি ব্যারেল। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭১ ডলারে। এ অবস্থায় যেসব দেশ রয়েসয়ে খরচ করেছে ও অপব্যয়কে পরিহার করছে, তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার মতো অবস্থাও সরকারের নেই। তাই জ্বালানি আমদানিতে ভাটা পড়েছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি দিতে পারছে না। অথচ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গত ১০ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে সরকার। অপখরচ, পাচার এবং অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব বিদ্যুৎ খাতের ওপরে কিছুটা পড়েছে। এটা তো একটা খাতের বিষয়। কিন্তু সার্বিকভাবে অর্থ পাচারনির্ভর অটেকসই উন্নয়ন নীতি ও অপখরচের প্রভাব দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
● ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক