অপমৃত্যু ঠেকাতে সুশাসনের বিকল্প নেই
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টায় আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর শোক না কাটতেই ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আবার ঘটে অগ্নিকাণ্ড, যাতে প্রাণহানি ঘটেছে ২৬ জনের। সড়কে প্রতিনিয়ত হতাহতের ঘটনা ঘটছেই। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নুসরাতকে। একই সঙ্গে চলছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ সম্পর্কিত মৃত্যুর নজিরবিহীন রেকর্ড। কটিয়াদীতে চলন্ত বাসে এক নারীকে ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগের খবর পত্রিকায় পাওয়া গেল গতকাল বুধবার। এসবই অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু। এর সঙ্গে শাসন প্রক্রিয়ার ত্রুটিবিচ্যুতি বা চূড়ান্ত অর্থে অপশাসনের সম্পর্ক রয়েছে।
অপশাসনের বিপরীত হলো সুশাসন। আর এ দুটোর মূলে রয়েছে শাসন। শাসন হলো যেকোনো প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থা ও উদ্যোগকে কার্যকর করার প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। আর এ প্রক্রিয়ার অংশ হলো কতগুলো রুল বা বিধি-বিধান, মূল্যবোধ, পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও ক্ষমতা। যখন রুল, মূল্যবোধ, পদ্ধতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সঠিক ও ক্ষমতার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, তখনই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এ ব্যত্যয় ঘটলেই অপশাসনের সৃষ্টি হয়। সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণ বিধি-বিধান ও মূল্যবোধ এবং পদ্ধতির ঘাটতি। অথবা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতা। অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার। কিংবা সবগুলোরই উপস্থিতি।
ক্ষমতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একে কুক্ষিগত করা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করা। এর মূলে কাজ করে মানবিক দুর্বলতা। ক্ষমতা কুক্ষিগত ও অপব্যবহারের পেছনে মূল আকর্ষণ হলো, এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থ চরিতার্থ করা যায়। নিজে অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া যায় অথবা অন্যকে বিত্তশালী করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে বিধি-বিধান ও মূল্যবোধ, যার ব্যবহার অবশ্য নির্ভর করে যথার্থ পদ্ধতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী ও কার্যকর হলেই বিধি-বিধান ও মূল্যবোধ ব্যবহার করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এ জন্য অবশ্য বিধি-বিধান এবং মূল্যবোধও সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
যেকোনো রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে কতগুলো আইন, বিধি-বিধান ও মূল্যবোধ এবং স্বীকৃত পদ্ধতি থাকে। এগুলো ব্যবহার করে কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে। তা না করা গেলে শাসনব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। শুরুতে বিশৃঙ্খলা এবং কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দেশ শেষ পর্যন্ত অপশাসনের কবলে পড়ে। এমন পরিস্থিতি নাগরিকের জন্য কল্যাণকর নয়, নাগরিকের অপমৃত্যু এসবেরই পরিণতি।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য আইনকানুন বিরাজমান। সঠিক পদ্ধতিও রয়েছে, যদিও পদ্ধতিকে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সাধারণত দুর্বল হয়, বিশেষত অযোগ্য, দুর্বল মূল্যবোধের অধিকারী ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নিয়োগের কারণে। আর এসব ব্যক্তিরাই ÿক্ষমতার অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার করে অপশাসন বা অগ্রহণযোগ্য ফলাফলের সৃষ্টি করে।
আমাদের সাম্প্রতিক নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়। আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মোটামুটি গ্রহণযোগ্য আইনকানুন ও পদ্ধতি রয়েছে—বিদ্যমান আইনকানুন ও পদ্ধতি ব্যবহার করেই ড. হুদা কমিশনের অধীনে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করা গেছে। কিন্তু বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনের সদস্যদের অধিকাংশের যোগ্যতা, সততা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, যা আমাদের নির্বাচন কমিশনকে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আর এ দুর্বল কমিশনই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচন পদ্ধতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ করে এমন একটি নির্বাচন উপহার দিয়েছে, যা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই কার্যত অকার্যকর করে ফেলেছে। এটা সুশাসনের বিপরীত।
২০১০ সালের নিমতলীর এবং এবারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের কথায় আসা যাক। আবাসিক এলাকায় দাহ্য পদার্থের গুদাম রাখার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে, যদিও তা আরও জোরদার করা দরকার। এসব প্রয়োগের জন্য পদ্ধতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে, কিন্তু নিজেদের অপারগতা এবং ÿক্ষমতার অপপ্রয়োগের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান এগুলো প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে ঘটেছে অনেক ব্যক্তির অপমৃত্যু।
নিমতলী ও চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পর উভয় ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটি সুপারিশও প্রদান করে। চকবাজারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি, যার ফলে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ঘটেছে অপমৃত্যু। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারও তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেমে গিয়েছে (ইত্তেফাক, ২১ এপ্রিল ২০১৯)। এর কারণ হলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষমতার সঠিক ব্যবহারে অপারগতা।
পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামে বারবার ঘটা অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, যে প্রতিষ্ঠানটি হলো আমাদের জাতীয় সংসদ। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো নজরদারি। আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ থাকে—নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন—যেগুলো এক অপরের ওপর নজরদারি করে, যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত ও অপব্যবহার করে নাগরিকের অধিকার হরণ করা না যায়। আমাদের দেশে ক্ষমতার এ বিভাজন ভেঙে পড়েছে—প্রায় সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে চরম পরাক্রমশালী নির্বাহী বিভাগে। পাতানোর পরিবর্তে সত্যিকারের বিরোধী দলের উপস্থিতিতে আমাদের জাতীয় সংসদ এবং সংসদীয় কমিটিগুলো যদি কার্যকর হতো, তাহলে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে অপারগতার কারণে দায়ী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। একইভাবে চূড়িহাট্টার অগ্নিকালর পর সংসদে মুলতবি প্রস্তাব এনে তুমুল আলোচনা হতো।
আমাদের সড়কপথ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার কারণও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিধি-বিধান ও পদ্ধতির দুর্বলতাও, যা অযোগ্য চালকদের এবং অযোগ্য যানবাহনকে সড়কের বাইরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে—এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থাই সড়কে প্রাত্যহিক মৃত্যুর মিছিলের মূল কারণ। আমাদের তরুণেরা গত বছর নিরাপদ সড়ক সৃষ্টির লক্ষ্যে তাই যথাযথভাবেই রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তুলেছিল।
এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও রয়েছে আমাদের ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থা বা অপশাসন। বহুতল বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণের জন্য বিধি-বিধান রয়েছে। রয়েছে এগুলো অনুমোদনের যথাযথ পদ্ধতি, যা দুর্নীতির কারণে প্রভাবিত হয়েছে। ফলে রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান বিধি-বিধান প্রয়োগে ও যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও রয়েছে রাজউকের দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও তাদের ÿক্ষমতার অপপ্রয়োগ।
একইভাবে সারা দেশে ধর্ষণের এবং তার থেকে মৃত্যুর যে মহামারি আজ শুরু হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে আমাদের ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে আইনকানুন রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার করে তা তদন্ত করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী ব্যক্তি/ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়াও সম্ভব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি এবং পদ্ধতির ওপর অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আমাদের দেশে আজ একধরনের ‘কালচার অব ইম্পিউনিটি’ বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
দলীয়করণ, দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদান এবং এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কারণেই এসব প্রতিষ্ঠানের আজ করুণ অবস্থা। ফলে ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। নুসরাতের নৃশংস হত্যার ঘটনা ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—এই তিন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্ট এক চক্রের ব্যর্থতারই ফসল।
পরিশেষে, আমাদের সমাজে আজ যেসব অন্যায়, অবিচার, অস্থিরতা ও অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তার পেছনে রয়েছে শাসন পরিচালনার ত্রুটি। এর বিপরীতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের আইনকানুন ও বিধি-বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। জাগ্রত করতে হবে মূল্যবোধ। একই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে প্রভাবমুক্ত যথাযথ পদ্ধতি এবং শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান, যার জন্য প্রয়োজন হবে দলীয়করণ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ÿক্ষমতার অপব্যবহারের অবসান।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক