গত ২৭ জানুয়ারি বহু তর্ক-বিতর্ক, দোষারোপ ও নাটকীয়তার পর ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। অবশ্য এতে নতুনত্ব কিছু নেই, মূলত এর মাধ্যমে অতীতের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনকেই আইনের পোশাক পরানো হয়েছে মাত্র। অনেকের মনেই আইনটির উপযোগিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে এবং তাঁরা এটির খোল নলচে বদলানোর পক্ষে, যা অদূর ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
যাই হোক, সেই আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। তাই এখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো, এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব জনকল্যাণমুখী করতে সচেষ্ট হওয়া, যাতে সঠিক ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার পথ কিছুটা হলেও প্রশস্ত হয়।
নামে অনুসন্ধান কমিটি হলেও বাস্তবে যা ঘটে, আপিল বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল মতিনের বয়ানে তা ধরা পড়ে। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রথম দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগের সার্চ কমিটিতে সদস্য এবং পরবর্তীকালে মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন নিয়োগসংক্রান্ত সার্চ কমিটিতে চেয়ারম্যান ছিলাম। নতুন আইনে আগের সার্চ কমিটির একই ফর্মুলা রাখা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান বা সদস্যদের করার তেমন কিছুই থাকে না। কয়েকটি খামের মধ্যে ক্যাবিনেট ডিভিশন দ্বারা সরকারের পছন্দের কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ থাকে না।’ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২২)।
তাই এটি সুস্পষ্ট যে অতীতের অনুসন্ধান কমিটিগুলো সত্যিকারের অনুসন্ধান পরিচালনার পরিবর্তে মূলত পোস্ট অফিসের ভূমিকা পালন করেছে, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য সঠিক ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হলে অনুসন্ধান কমিটিকে এই লোকদেখানো ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের অনুসন্ধান পরিচালনা করতে হবে।
আইনের ৪ (১) ধারায় নির্ধারিত অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি হলো—‘অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করিবে।’
এই দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য কমিটিকে আইনের ৩ (২) ধারায় তার সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ দুটি বিধানকে কাজে লাগালে অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে যোগ্য, অভিজ্ঞ, সৎ ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।
তবে অনুসন্ধানের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নাম আহ্বান করা। আইনের ৩ (৩) ধারায় বলা আছে, অনুসন্ধান কমিটি ‘রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’
এটি সুস্পষ্ট যে অতীতের অনুসন্ধান কমিটিগুলো সত্যিকারের অনুসন্ধান পরিচালনার পরিবর্তে মূলত পোস্ট অফিসের ভূমিকা পালন করেছে, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য সঠিক ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হলে অনুসন্ধান কমিটিকে এই লোকদেখানো ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের অনুসন্ধান পরিচালনা করতে হবে।
এই ধারা থেকে সুস্পষ্ট, কমিটি অন্যদের কাছ থেকেও নাম আহ্বান করতে পারবে। তাই আমাদের অনুরোধ হবে, কমিটি যেন নাম আহ্বানের ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করে। কারণ, রাজনৈতিক দলের তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়ার ঝুঁকি হলো—কে কার নাম প্রস্তাব করছে, তা জানাজানি হলে—যা বাস্তবে হবেই—নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, অনেক ক্ষেত্রে অযাচিতভাবেই, দলীয় সংশ্লেষের অভিযোগ উঠতে পারে।
আইনের ৫ ধারায় নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, ৫০ বছর বয়স ও ২০ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনের ৬ ধারায় দেউলিয়াত্ব, অপ্রকৃতিস্থতা, বৈদেশিক নাগরিকত্ব, যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এসব যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি পূরণ করে এমন হাজার হাজার ব্যক্তি বাংলাদেশে রয়েছেন, তাই কমিটির পক্ষে তাঁদের মধ্যে যেকোনো ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা ১০ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
কিন্তু কেবল আইনের ৫ ও ৬ ধারার যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করলেই কোনো ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত হয়ে যান না। কারণ কমিশনকে সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্ধারিত সংসদ নির্বাচনসহ আরও অনেকগুলো সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব দায়িত্ব পালনের জন্য আরও বড় বা ‘সুপিরিয়র’ যোগ্যতা আবশ্যক, যা আইনের ৪ (১) ধারায় বলা আছে।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য যে সুপিরিয়র যোগ্যতা অপরিহার্য তা হলো ব্যক্তির সততা ও সুনাম। জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন নিরপেক্ষতা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞাসম্পর্কিত সুনাম।
ব্যক্তির সুনাম-দুর্নাম ব্যক্তি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা বা প্রচলিত বিশ্বাস, যা যাচাই করার সঠিক ও উপযুক্ত মাধ্যম হলো জনতার আদালত। বস্তুত জনগণের মতামতই এর একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্ণায়ক। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য বিবেচিত ব্যক্তিদের নাম যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলেই তাঁদের সুনাম-দুর্নাম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যা চালুনির ভূমিকা পালন করে সঠিক ব্যক্তিদের বেছে নিতে সহায়তা করবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের দূরে রাখবে।
উদাহরণস্বরূপ, বিবেচিত ব্যক্তিদের নামগুলো প্রকাশিত হলে তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালি জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে কি না কিংবা তাঁদের কোনোরূপ দলীয় সংশ্লিষ্টতা আছে কি না ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসবে।
অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন নামগুলো দুইবার প্রকাশ করা আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। প্রথমবার বিভিন্ন সূত্র থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত নামগুলো প্রাপ্তির পর এগুলো বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা—যেমন ২০ জনের নামের তালিকা। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সম্মতি সাপেক্ষে, কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে পারে।
এরপর সাক্ষাৎকার গ্রহণ, শুনানিসহ বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান পরিচালনার পর অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য যে ১০ জনের নামের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করবে, তা একটি প্রতিবেদনসহ প্রকাশ করতে পারে। কোন যোগ্যতার কারণে এবং কোন যুক্তিতে তাঁরা চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেলেন, তা এ প্রতিবেদনে থাকবে এবং চূড়ান্ত তালিকা ও প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের অন্তত তিন দিন আগে কমিটি এগুলো গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে, যাতে জনগণ তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় পান।
প্রসঙ্গত, গত অনুসন্ধান কমিটির সদস্য সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও, অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় শুনানির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘প্রতিটি সাংবিধানিক নিয়োগেই শুনানিনির্ভর আইন চাই’। উল্লেখ্য, প্রতিবেদনটিতে শুনানির মাধ্যমে স্বচ্ছতার চর্চা করলেই বর্তমান সিইসির বিতর্কিত অতীতের বিষয়টিও এড়ানো যেত বলে দাবি করা হয়।
পরিশেষে, অতীতে অনুসন্ধান কমিটি পোস্ট অফিসের মতো ভূমিকা পালন করার ফলে সরকার তার অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে সমর্থ হয়েছে, যাঁরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন। আবারও একটি অনুগত নির্বাচন কমিশন জাতি হিসেবে আমাদের চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই নবগঠিত অনুসন্ধান কমিটিকে সঠিক ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ জন্য বাছাই করতে হবে। আইনের ৪ (১) ধারায় উল্লেখিত ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি’ অনুসরণ করে ‘অনুসন্ধান’ করলেই তা সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক