প্রথমেই আমি অনুসন্ধান কমিটিকে ধন্যবাদ জানাই, আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। এমনিভাবে ২০১৭ সালেও আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম, লিখিতভাবে কিছু পরামর্শও দিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন সূত্র থেকে যেন নাম নেওয়া হয়, বিবেচনাধীন নামগুলো গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয় এবং তাঁদের সম্পর্কে গণশুনানি করা হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা নাম, কোন যোগ্যতাবলে তাঁদের নাম সুপারিশ করা হয়েছে—সে–সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনসহ যেন প্রকাশ করা হয়। আমার যতটুকু মনে পড়ে, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু এগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। তবু আজ আমি উপস্থিত হয়েছি আপনাদের আমন্ত্রণের প্রতি সম্মান জানাতে এবং আমার মনে কিছু প্রশ্ন ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে, তা প্রকাশ করতে। একই সঙ্গে আমার পুরোনো সুপারিশগুলো উত্থাপন করতে।
আমার প্রথম প্রশ্ন, অনুসন্ধান কমিটি কি আসলেই অনুসন্ধান করে? আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম এ মতিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জেনেছি যে ক্যাবিনেট ডিভিশন থেকে অনুসন্ধান কমিটিকে সরকারের পছন্দের কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং এর বাইরে তাদের তেমন কিছুই করার থাকে না (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২২)। অর্থাৎ অতীতে অনুসন্ধান কমিটি মূলত পোস্ট অফিসের ভূমিকাই পালন করেছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আমরা জেনেছি যে ২০১৭ সালে ক্ষমতাসীন দল কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের শরিকদের এবং সমমনা দলগুলোর মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নাম বারবার প্রস্তাব করিয়ে অনুসন্ধান কমিটির সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। প্রথম আলোর (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘২০১৭ সালে অন্তত চারটি দল সিইসি হিসেবে কে এম নূরুল হুদার নাম প্রস্তাব করেছিল। দলগুলো হচ্ছে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ ও তরিকত ফেডারেশন, (যদিও ওয়ার্কার্স পার্টি তা অস্বীকার করেছে)। কমিশনার রফিকুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করেছিল পাঁচটি দল— জাতীয় পার্টি (জাপা), জাসদ, সাম্যবাদী দল, তরিকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। কবিতা খানমের নাম প্রস্তাব করেছিল আওয়ামী লীগ, সাম্যবাদী দল ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টি। শাহদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছিল সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। এর বাইরে মাহবুব তালুকদারের নাম প্রস্তাব করেছিল বিএনপি।’ গত অনুসন্ধান কমিটির সদস্য প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রথম আলোকে (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) দেওয়া এক সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ‘নবনিযুক্ত সিইসির নাম সাত-আটটি এবং আলী ইমাম মজুমদারের নাম দুটি দল থেকে এসেছিল।’ এ থেকে প্রতীয়মান হয়, একাধিক দল কর্তৃক বারবার নাম প্রস্তাব করার কারণেই কে এম নূরুল হুদার নাম সিইসি পদের জন্য কমিটির সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট ও প্রণিধানযোগ্য—প্রথমত, নির্বাচন কমিশনে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে ক্ষমতাসীন দল আগে থেকেই তা ঠিক করে রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য অনুসন্ধান কমিটির চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। তৃতীয়ত, অনুসন্ধান কমিটি মনে হয় যেন সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করার পরিবর্তে টালি করে সবচেয়ে বেশি বার প্রস্তাবিত নামই সুপারিশ করেছিল। ফলে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের চারজনই রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা দশজনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট ও প্রণিধানযোগ্য—প্রথমত, নির্বাচন কমিশনে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে ক্ষমতাসীন দল আগে থেকেই তা ঠিক করে রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য অনুসন্ধান কমিটির চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। তৃতীয়ত, অনুসন্ধান কমিটি মনে হয় যেন সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করার পরিবর্তে টালি করে সবচেয়ে বেশি বার প্রস্তাবিত নামই সুপারিশ করেছিল। ফলে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের চারজনই রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা দশজনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন। নূরুল হুদার মতো জয়েন্ট সেক্রেটারির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সম্পূর্ণ অচেনা ব্যক্তির পক্ষেও সিইসি হিসেবে অত্যন্ত সংবেদনশীল দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রসঙ্গত, নূরুল হুদার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সর্বোপরি তিনি বিএনপির চরম বিরাগভাজন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুগ্রহভাজন ছিলেন। পূর্বনির্ধারিত চারজনকেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে পারা নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এক অসামান্য সফলতা।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, অনুসন্ধান কমিটির সদস্যরা কি ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ প্রদর্শন করেননি? ডিউ ডিলিজেন্স বলতে বোঝায়, সাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বারা অবস্থাবিশেষে যে রকম সতর্কতা এবং সুবিবেচনা প্রয়োগ করা হয়, সে রকম সতর্কতা বা সুবিবেচনা প্রদর্শন। ‘ব্ল্যাক ল ডিকশনারি’ অনুযায়ী, ডিউ ডিলিজেন্স দুই ধরনের হয়—সাধারণ বা কমন এবং উচ্চপর্যায়ের বা হাই ডিউ ডিলিজেন্স। অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের কেউই সাধারণ মানুষ নন, তাই তাঁদের কাছ থেকে অধিকতর সতর্কতা ও সুবিবেচনা আশা করাই স্বাভাবিক।
আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতিনিয়ত ডিউ ডিলিজেন্স বা সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সুবিবেচনার চর্চা করে থাকি। যেকোনো নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রেই আমরা খোঁজখবর নিই। প্রার্থীদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হই। অফিস-আদালতে চাকরিপ্রার্থীদেরও আমরা পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার নিই। রেফারেন্স চেক করি। কিন্তু আমাদের বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে কি কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে? এ প্রশ্ন আমার মতো অনেকেরই।
সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিবেচনা ব্যবহার না করলে যে ক্ষতি হয়, তার দায় কাউকে না কাউকে নিতে হয়। কিন্তু নূরুল হুদা কমিশনের অপকর্মের দায় কে নেবে? এটি সুস্পষ্ট যে নূরুল হুদা এবং তার আগের কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে, যার কারণে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের ব্যাপক অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সুজনের পক্ষ থেকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তথ্য অধিকার আইনের অধীন দরখাস্ত করে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফলের তথ্য সংগ্রহ করে (যে তথ্য অতীতে নির্বাচন কমিশন নিজেরাই প্রকাশ করত) তা বিশ্লেষণ করে জালিয়াতির নির্বাচনের অকাট্য প্রমাণ হাজির করেছি। আমরা দেখিয়েছি, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি ও ২টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ শূন্য ভোট পেয়েছে এবং ৫৯০টি কেন্দ্রে বৈধ ভোটের সবগুলোই মাত্র একটি প্রতীকে পড়েছে। এসব অবিশ্বাস্য তথ্য–প্রমাণ করে যে ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। এসব কারণে বিচারপতি আবদুল মতিনের ভাষায়, বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নির্বাচন কমিশন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। আমরা ৪২ জন নাগরিকের পক্ষ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে গুরুতর অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। এখন আমার মতো অনেক নাগরিকের কাছেই প্রশ্ন, বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনের সব অপকর্মের দায় কি অন্য কারও আছে? এ জন্য নিয়োগকর্তা এবং সুপারিশকারীরা কি তাদের দায় এড়াতে পারেন?
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেউই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। আমরা ৪২ জন নাগরিকের পক্ষ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে গুরুতর অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হয়েছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। এখন আমার মতো অনেক নাগরিকের কাছেই প্রশ্ন, বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনের সব অপকর্মের দায় কি অন্য কারও আছে? এ জন্য নিয়োগকর্তা এবং সুপারিশকারীরা কি তাদের দায় এড়াতে পারেন?
রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত পূর্বের অনুসন্ধান কমিটির ওপর জনগণের একধরনের আস্থা ছিল। জনগণ রাষ্ট্রপতিকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু দুজন রাষ্ট্রপতি দুই–দুইবার অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে এবং সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে যাঁদেরকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের দ্বারা আমরা আশাহত হয়েছি। একটি বিখ্যাত উক্তি—‘ইউ ফুল মি ওয়ান্স, শেইম অন ইউ, ইউ ফুল মি টুয়াইস, শেম অন মি’। আমরা দুই–দুইবার বোকা বনেছি, আবারও বোকা বনতে চাই না।
আরেকবার আমাদের বোকা বানালে আমরা জাতি হিসেবে চরম সংকটের দিকে ধাবিত হতে পারি। তাই আপনারা যাঁরা বর্তমান অনুসন্ধান কমিটিতে আছেন, তাঁদের কাঁধে গুরুদায়িত্ব পড়েছে। আমি আশা করি, আপনারা এ গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবেন, যাতে আস্থার সংকট দূর হয়।
তবে আপনাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর একটি হলো, সম্প্রতি প্রকাশিত আইনের সীমাবদ্ধতা। বস্তুত, যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সরকারের অনুগতদের নিয়ে অতীতে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা যেত, নতুন আইনের মাধ্যমে একই কাজ কার সম্ভব। অনুসন্ধান কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে এবারও ক্ষমতাসীন দল ২০১৭ সালের কৌশল অবলম্বন করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২), যেটা অনুসন্ধান কমিটির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
এরই মধ্যে আমরা যেসব আলামত পাচ্ছি, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম বৈঠকে অংশ নেওয়া সার্চ কমিটির এক সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, গতবার সার্চ কমিটি যেভাবে কাজ করেছিল, এবারও সেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। এ ছাড়া আমরা শুনেছি যে কাদের নাম অনুসন্ধান কমিটি বিবেচনা করছে এবং কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে, সে তালিকা প্রকাশ করা কমিটি সমীচীন মনে করছে না। আমরা জানি না, কোন আইন বা বিধির বলে কমিশন এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে (যদি নিয়ে থাকেন)। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে পুরোনো পথে হাঁটলে নতুন গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না। পুরোনো পদ্ধতিতে ‘অনুসন্ধান’ করলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পাওয়া যাবে না।
তবে আমরা আশাবাদী হতে চাই। আইনের ৪ (১) ধারায় অনুসন্ধান কমিটিকে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে সৎ, যোগ্য ও সুনামের অধিকারীদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদানের জন্য সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করতে হলে এমন একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে, যাতে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, দক্ষতা ও সুনাম-দুর্নাম সম্পর্কে কোনো কিছু গোপন না থাকে। বিখ্যাত আমেরিকান বিচারপতি লুইস ব্রান্ডাইস বলেছেন যে ‘সানলাইট ইজ দ্য বেস্ট ডিজইনফেক্টেন্ট’ অর্থাৎ, সবকিছু প্রকাশ্যে করাই স্বচ্ছতার সত্যিকারের মানদণ্ড।
এ ছাড়া ব্যক্তির সুনাম-দুর্নাম পরিমাপের কোনো নিক্তি নেই, জনশ্রুতিই এর একমাত্র নির্ণায়ক। শুধু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে আস্থায় নিলেই এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করতে দিলেই যেকোনো ব্যক্তির সুনাম-দুর্নাম সম্পর্কে জানা যাবে। জানা যাবে যেসব ব্যক্তির নাম আপনারা বিবেচনা করছেন, তাঁদের জীবনযাত্রা প্রণালি তাঁদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে কি না, তাঁদের কোনো দলীয় সংশ্লেষ আছে কি না, তাঁরা সাহসী ও প্রজ্ঞাবান কি না ইত্যাদি। এসব উচ্চতর যোগ্যতা, যা নির্ণয়ের একমাত্র ভিত্তি হলো জনগণের মতামত এবং জনমত বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিবেচনা প্রয়োগ করে সুপারিশ করলেই সঠিক ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। এ ছাড়া তথ্যের সঙ্গে সত্যের যোগ সূত্রতা আছে, তাই তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য সত্য জানা কাউকে হয়রানি করা নয়, কিংবা কারও চরিত্র হনন করা নয়। এ ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গোপনীয়তার সংস্কৃতির কোনো স্থান নেই।
অনুসন্ধান কমিটির কাছে আমার সুস্পষ্ট সুপারিশ:
(১) আইনে বর্ণিত ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি’ অনুসরণের জন্য কমিটি কী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এবং ‘সুনামের’ অধিকারী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য কী মানদণ্ড চিহ্নিত করেছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করুন। আস্থার সংকটের অবসানের জন্য জাতি আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
(২) যে ৩২৯ জনের নাম এরই মধ্যে অনুসন্ধান কমিটির কাছে প্রস্তাবিত হয়েছে, স্বচ্ছতার খাতিরে সে তালিকা এবং কোন ব্যক্তি, দল বা সংগঠন কর্তৃক তারা প্রস্তাবিত হয়েছে তাদের নাম অনতিবিলম্বে গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করুন। প্রসঙ্গত, বিকল্প ধারা ও গণফ্রন্ট এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাবিত নামগুলো প্রকাশ করেছে।
(৩) সর্বোচ্চ সতর্কতা ও বিবেচনা ব্যবহার করে ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে, যার মধ্যে পাঁচজন হবেন নারী, এটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করুন। প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে সততা, যোগ্যতা এবং সুনামই যেন বিবেচ্য বিষয় হয়। প্রাথমিক তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করুন এবং তাঁদের সম্পর্কে প্রকাশ্য শুনানির আয়োজন করুন। প্রসঙ্গত, প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও তাঁর প্রথম আলোতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন ব্যক্তিদের সম্পর্কে শুনানির ওপর জোর দিয়েছেন।
(৪) সততা ও সুনাম-দুর্নামে বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অন্তত ৩ জন নারীসহ ১০ জনের
একটি চূড়ান্ত তালিকা একটি প্রতিবেদনসহ তৈরি করুন, যে প্রতিবেদনে কোন যোগ্যতাবলে এসব ব্যক্তির নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো, তা লিপিবদ্ধ থাকবে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের তিন দিন আগে চূড়ান্ত তালিকাটি প্রতিবেদনসহ গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করুন, যাতে নিয়োগের আগেই জনগণ জানতে পারে কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ এরই মধ্যে নামগুলো প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। আপনাদের কাজ সম্পন্ন হলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রকাশ করুন, যাতে জাতি জানতে পারে কী ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে আপনারা ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেছেন এবং যা পরবর্তী অনুসন্ধান কমিটির কাজে লাগবে।
পরিশেষে, সম্প্রতি প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম ধাপ, কিন্তু এ লক্ষ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এমনকি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা খোন্দকার আবদুস সালাম বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে [৬ এএলআর (স্পেশাল ইস্যু) ২০১৫] বিচারপতি মির্জা হায়দার হোসেন ও বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকারও নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের ফর্মুলা খুঁজে বের করার পক্ষে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তাই নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতার বিষয়টি আমাদের ভুললে চলবে না।
আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২)