স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি। এই পটভূমিতে ভাষা দিবসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত মহিউদ্দিন ফারুকের একটি লেখা মন দিয়ে পড়লাম, যার শিরোনাম ‘উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশ লেখা বাড়ছে’। লেখাটির অনন্য উদ্যোগ ‘আমার ভাষা’ সফটওয়্যার উপশিরোনামের অংশটুকু বিশেষ নজর কেড়েছে।
‘আমার ভাষা’ সম্বন্ধে কিছু বলার আগে নিম্ন আদালতে বাংলা প্রচলনের অবস্থাটাও জানা দরকার। এ নিয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা হলো ফোনে। তিনি জানালেন, ১৯৮৭ সালের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’-এর ৩ (৩) উপধারায় বাংলা ব্যবহার না করলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তির বিধান রাখায় ফৌজদারি আদালতগুলোয় বাংলা চালু হয়ে যায়। প্রায় সব ম্যাজিস্ট্রেট বাংলায় আদেশ লেখা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে রায়গুলোও বাংলায় লিখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘নতুন কিছু চালু করার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বাধা থাকলেও মাতৃভাষা প্রচলনের তাগিদেই সবাই তা মেনে নেন। রায় বা আদেশ লেখার ক্ষেত্রে অনেক সময় ইংরেজিতে লেখা আইনে ব্যবহৃত শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ জুতসই মনে হতো না। সে ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দটাই বাংলা অক্ষরে লিখে দিয়েছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আরও বলেন, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি চালু হওয়ার সময় সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল স্বীকৃত আইনি পরিভাষার অভাব; ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড, সিভিল প্রসিডিউর কোড, বিস্ফোরক আইন ইত্যাদি পুরোনো আইনগুলোর কোনো স্বীকৃত বাংলা অনুবাদের অভাব। এগুলোর কিছু কিছু বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়, কিন্তু অনেকগুলোই মানসম্পন্ন নয়। তবে গাজী শামসুর রহমান যেগুলো অনুবাদ করেছেন, সেগুলোর ভাষা সরল এবং সহজবোধ্য। তিনি কিছু আইনের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, যেগুলো মামলার কার্যক্রমে মান্য করা হতো।
অবসরপ্রাপ্ত ওই ম্যাজিস্ট্রেটের মতে, একটি স্বীকৃত পরিভাষা সংকলন এবং উচ্চপর্যায় থেকে, যেমন জেলা জজ বা চিফ ম্যাজিস্ট্রেট স্তর থেকে নিয়মিত তদারকি করা হলে নিম্ন আদালতে বাংলা প্রচলনে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, ইতিমধ্যে বাংলা ব্যবহারে অভ্যাস হয়ে গেছে। পরিভাষার সমস্যা সমাধানে ১০ হাজার শব্দের আইন শব্দকোষ প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। সেটা সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ভারতীয় হাইকমিশন সফটওয়্যারটি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে, যা এখন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে জাতীয় ডেটা সেন্টারের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে ৭০ ভাগ সঠিক অনুবাদ হয়। বাকিটুকু ম্যানুয়ালি ঠিক করে নিতে হবে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
দেখা যাক ‘আমার ভাষা’র ‘৭০ ভাগ সঠিক অনুবাদ’ আসলে কেমন। ফেসবুক এবং টুইটার থেকে যে নমুনা পাওয়া যাচ্ছে তার একটি উদ্ধৃত করছি। ‘পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট/ফৌজদারি সংশোধনী এখতিয়ার/আব্দুল হাকিম, জে/May ৬, ১৯৬৯ /অস্পষ্ট/রাজ্য...অপ। পার্টি কেস*/পাকিস্তান বিধি ১৯৬৫ এর বিধি ৪৭ (৫) এবং ৪১ (৬) /কতটুকু বাক্স্বাধীনতা রোধ করা যায়।
যতক্ষণ জমির আইনবিরোধী কার্যকলাপ এবং কিছু পরিমাণ চিন্তাভাবনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অনুমতি দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল মতপ্রকাশের বিষয়টি সরকারের পক্ষে হতে পারে, তবে এটি অপ্রতিরোধ্য, এটি স্পিকারকে প্রতিরক্ষা অধীনে কোনো পদক্ষেপের জন্য দায়বদ্ধ করে না পাকিস্তান বিধি, যদি না এই মতামত এই অঞ্চলের জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত করতে বা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি বা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি উদ্দীপনা বা ভয় এবং জনসাধারণের কাছে বিপদ ডেকে আনে।’
ধরে নিচ্ছি, ওপরের অংশটুকুর অনুবাদ ৭০ ভাগ সঠিক। একজন অনুবাদ পেশাজীবী রায়ের এই অংশটুকু কি সহজে শুদ্ধ করতে পারবেন। অনুবাদক হিসেবে মনে হয়েছে, এটুকু সংশোধন করতে গেলে তা নতুন করে অনুবাদ করতে হবে। এখানে সমস্যা হচ্ছে ‘জমির আইন’, ‘কিছু পরিমাণ চিন্তাভাবনা’, ‘অনুমতি দেয়’, ‘প্রতিরক্ষা অধীনে’, ‘এটি...পাকিস্তান বিধি’, ‘উদ্দীপনা বা ভয়’ এবং ‘কাছে’ শব্দ বা বাক্যাংশগুলো। অনুমান করি ‘জমির আইন’ বলতে দেশের আইন, ‘অনুমতি দেয়’ বলতে ইংরেজিতে সম্ভবত পারমিট বা অ্যালাউ, ‘কাছে’ বলতে ‘জন্য’ বোঝানো হয়েছে। বাকিগুলো লেখকের দুর্বোধ্য।
যন্ত্র-অনুবাদ বা অনুবাদ-যন্ত্রের ব্যাপারে লেখকের আগ্রহ বহুদিনের। আমি নিজে স্বশিক্ষিত এসকিউএল বা সিকুয়েল ভাষার প্রোগ্রামার। তাই অতীতে বাংলায় যন্ত্র-অনুবাদের কাজ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে পাইথন প্রোগ্রামিং ভাষা শেখার চেষ্টা করেছিলাম। সেই সুবাদে যতটুকু বুঝি ওপরের অংশটুকু অনুবাদের ব্যাপারে যন্ত্রের বা কম্পিউটারের সমস্যা লেক্সিকন এবং করপাস বিশ্লেষণের সমস্যা। লেক্সিকনকে বলা যায় পরিভাষা এবং করপাস হচ্ছে শরীর বা বিষয়বস্তু (হেবিয়াস করপাস নামে একটি আইন রয়েছে যাতে সশরীরে উপস্থিতি বোঝানো হয়)। করপাস হলো বক্তব্য বা বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করার জন্য বাক্যাংশের অর্থ এবং কোনো শব্দ কোনো জায়গায় কী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার একটি বিশাল অভিধান।
একটি উদাহরণ দিলে বোঝানো সহজ হবে। The cow lives on grass বাক্যটি অনুবাদ করার ক্ষেত্রে যন্ত্র যদি করপাস অভিধানে The cow এবং lives on-এর অর্থ না পায়, তাহলে অনুবাদ করবে ‘গরুটি থাকে ওপর ঘাস’। আর করপাসে তা পেলে অনুবাদ করবে ‘গরু ঘাসে বাঁচে’। ভালো একটি করপাস অভিধান পেলে যন্ত্র অনুবাদ করবে ‘গরু ঘাস খায়’।
অনুমান করি, ওপরের উদ্ধৃতিতে ‘জমির আইন’ বলতে ‘ল অব দ্য ল্যান্ড’ (Law of the land), ‘সরকারের প্রতি উদ্দীপনা’ বলতে প্রভোকেশন/এজিটেশন এগেইন্সট দ্য গভর্নমেন্ট’ (provocation/agitation against the government) ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। এখানে মূল ইংরেজি কী ছিল, তা অনুমানের চেষ্টা করেছি ‘আমার ভাষা’র ৩০ ভাগ সংশোধন করার ব্যাপারে সমস্যা কী হতে পারে, বোঝানোর জন্য। তা কেবল অনুমানের ব্যাপারে। আদালতের কোনো রায় অনুমাননির্ভর অনুবাদের বিপদ পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারবেন। সে জন্যই হয়তো ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার দোরাইস্বামী টুইটার বার্তায় ১৫ মাস ধরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ৯টি ভাষায় রায়ের অনুবাদের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘...তাই হ্যাঁ, আমরা নির্ভুল করার জন্য যত্নশীল হওয়ার বিষয়টা জানি।’
দ্বিতীয় আরেকটি নমুনায় পাওয়া গেল, ‘রায় রায়’, ‘পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা সরকার’,‘ত্বক। মজিবর রহমান’, ‘ফৌজদারি কার্যবিধি কোড (১৮৯৮ সালের ভি) সেকেন্ড। ভর্তি হওয়ার সময় খালাসের বিরুদ্ধে ৪১৭ আপিল প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আপিল দায়ের করেছে—আদালত বা আপিলকারী কেউই আপিল প্রত্যাহার করতে পারে না এবং আদালতও সেরূপ অনুমতি দিতে পারা (অবিকল) না। আপিল একবার গৃহীত হলে আদালত গুণাগুণ বিবেচনা করতে বাধ্য।’
এই দ্বিতীয় উদাহরণে ‘আপিল প্রত্যাহার করা যেতে পারে’ এবং ‘আপিল প্রত্যাহার করতে পারে না’ বাক্যাংশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখানে বিষয়বস্তু যে আপিল তা সামান্য বোঝা গেলেও অনুবাদটি সংশোধনের জন্য মূল রায় পড়া দরকার হবে বলেই মনে হয়। তাই ৩০ ভাগ সংশোধন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই তা ফের অনুবাদ করতে হতে পারে।
‘আমার ভাষা’ বা যেকোনো অনুবাদ সফটওয়্যারের লেক্সিকন এবং করপাস নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করতে হবে। ‘আমার ভাষা’ রচনাকারীরা সফটওয়্যারটি হালনাগাদ করার অধিকার সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে কি না, জানা নেই। তাই অনুমান করি, এটা হালনাগাদ করার জন্য বাংলাদেশিদের অধিকার এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু শুধু তা দিয়েই কি কাজটি করা যাবে?
‘আমার ভাষা’কে বাংলাদেশের জন্য হালনাগাদ করার কাজে এবং ৩০ ভাগ শুদ্ধিকরণ কাজে যে পরিশ্রম এবং টাকা ব্যয় করতে হবে, মনে হয় তা দিয়ে নিজেদেরই একটি অনুবাদ সফটওয়্যার হয়ে যেতে পারে। কারণ, হালনাগাদের কাজে আইনে দক্ষ বা আইনজ্ঞ এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামার এই দুই শ্রেণির লোকবল প্রয়োজন হবে। নতুন করে সফটওয়্যার রচনার বেলাতেও তাই।
প্রথম আলোরই আরেকটি প্রতিবেদনে আশার আলো দেখতে পাই। ২১ ফেব্রুয়ারির অনলাইন সংখ্যারই আরেকটি খবর ‘ভাষা নিয়ে গবেষণা থেকে এল পুরস্কার’। বাংলাদেশের ভাষা গবেষক সাজিয়া মেহনাজ করপাস এবং মানুষের ভাষার বিশ্লেষণ বা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং বিষয়ে গবেষণার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আউটস্ট্যান্ডিং করপাস থিসিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
খবরটা আশাজাগানিয়া, কারণ এতেই প্রমাণ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে করপাস ও লেক্সিকন তৈরি করার মতো মেধাবী বাংলাদেশে আছেন। আর বাংলাদেশেই যন্ত্র-অনুবাদক সফটওয়্যার রচনা করা সম্ভব। সে সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য দরকার কার্যকর উদ্যোগ।
যন্ত্র-অনুবাদের জন্য পাঠ্য বিষয়ের লেক্সিকন এবং করপাস রচনা কঠিন কাজ নয়, সময় এবং ভাষা দক্ষতাই তাতে বেশি প্রয়োজন। সাহিত্যের বেলায় সেটা বেশ কঠিন। কারণ, সাহিত্যে ভাষার অন্তর্নিহিত অর্থ উদ্ধার করার জন্য মানুষের মতো চিন্তা করার শক্তি যন্ত্রের থাকতে হবে।
কাজী জাওয়াদ লেখক ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক