দুঃখের খবরটা পাই মেঘালয় সীমান্ত পার হয়ে দেশের মাটিতে পা ফেলতেই। মধুপুর থেকে মোবাইল ফোনে জানান অজয় মৃ, অনিল মারান্ডি আর নেই। বললাম, আমি এইমাত্র তুরা থেকে ডালু বর্ডার হয়ে গ্রামে ফিরলাম। পরে রবীন্দ্রনাথ সরেনকে ফোন করলাম। রবীনদা বললেন, তিনি ঢাকায় এবং আজই ফিরবেন রাজশাহী। রবীনদাকে বললাম, সবার পক্ষ থেকে পরিবার ও স্বজনদের সমবেদনা জানাবেন।
ভেতরে-ভেতরে অনেক কষ্ট অনুভূত হলো। এবার বড়দিনের আগে আগে অনিলদার ফোন পাইনি। আমি নিজেও ফোন করিনি। অন্যান্য বছর তিনি ফোন করতেন এবং কিছু উপহারের আবদার করতেন। আমাকে ভালোবেসে, আপন জেনেই তিনি ফোন করতেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ বছর ডিসেম্বরে এমন ফোন আসেনি। ভেবেছি, নির্বাচন ও অন্যান্য অস্থিরতার কারণে হয়তো এমন হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে নিজ থেকে আমার অনিলদাকে ফোন করা উচিত ছিল, হয়নি। আমাদের জীবনে আরও কত কিছুই তো হয় না। যঁার একটু সম্মান পাওয়ার কথা, তঁাকে কি আমরা অকৃপণভাবে সম্মান দিই? অনিলদা অনেক কথা বলতে পারতেন। সুন্দর বাংলায় বক্তৃতা করতেন। সাঁওতালি বলতেন আরও তুখোড়। বেশি পড়াশোনা না করেও নেতৃত্বের বিশেষ গুণ তিনি অর্জন করেছিলেন নিজ চেষ্টায়। সম্ভবত ১৯৯৪ সালের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে নিয়মিত কলাম লিখি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ–এ। এটি আজকের কাগজ পত্রিকার সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। খুব জনপ্রিয় সেটি তখন। আমি কারিতাসে কাজ করতাম লেখালেখির পাশাপাশি। অফিসের কাজে গেলাম রাজশাহীর মহিষবাথান। যেহেতু প্রতি সপ্তাহে আমাকে খবরের কাগজ–এর জন্য লিখতে হয়, তাই একদিন পড়ন্ত বিকেলে সাঁওতালদের গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা অনিলদাকে জানালাম। তিনি তখন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি। আজ থেকে ২৪ বছর আগের কথা বলছি। মোটরসাইকেলে আমরা দুজন চলে যাই বরেন্দ্রভূমির নবাই বটতলা গ্রামে। রাস্তার দুধারে সবুজ ধানখেত। বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি উঁচু–নিচু ঢেউখেলানো, অদ্ভুত সুন্দর। প্রকৃতির মধ্যে একধরনের মায়াভরা রূপ আছে এখানে। সবুজ মাঠেরা যেন সিঁড়ির মতো নিচে নেমে গেছে। সাঁওতালি গ্রাম দেখে, মাটির ছবি আঁকা পরিচ্ছন্ন ঘর-উঠোন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মাটির দেয়ালে সাঁওতালেরা আলপনা আঁকে। গরিব হলেও এই মানুষদের রুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তা অসামান্য। পুরো গ্রামে হেঁটেছিলাম আমরা। হিলারিউস এক্কা নামের এক কলেজছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বস্তায় ধান ভরছিল সে। বর্গায় চাষ করা জমির ধান। ধানের অর্ধেক দিতে হবে মালিককে। সুন্দর মারান্ডি নামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আমলে এই গ্রাম বহুবার লুট করার চেষ্টা হয়েছিল। তির-ধনুক ধরে আমরা গ্রাম রক্ষা করেছিলাম। আমি না থাকলে এই গ্রামের সবাই দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেত।’
অনিলদা, আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই লেখা লিখছি। আপনি এখন অনন্তলোকে, অচেনা অন্য ভুবনে। আপনি নিশ্চয় আমাদের অপ্রকাশ্য সব গল্প, কাহিনি মনে রেখেছেন, যা অনেকেই জানে না। সংগ্রামের কত দীর্ঘ পথ চলেছি আমরা একসঙ্গে। আপনি আমার লেখালেখির জীবনের শুরুতে আমাকে অসম্ভব এক অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিলেন। আমার আদিবাসী মেয়ে বইয়ের ১৪৬ পৃষ্ঠায় আপনার কথা লেখা আছে। বইটি বেরিয়েছিল ১৯৯৭ সালে। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান।
আপনি অনেক অর্থকষ্ট, সীমাহীন অভাব ও অপ্রাপ্তি নিয়ে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নয় দফা প্রণীত হয় আপনার সময়ে। আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি ছিলেন আপনি শুরু থেকে। আমরা অনেক কিছু করতে পারিনি। মানুষের জীবনের সঙ্গে জীবন মেলানোর কাজ আমরা করতে চেয়েছিলাম, পারিনি হয়তো। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় চিরকাল শোষিত ও বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষেরা আর কীই–বা করতে পারে? তবে আপনি এই নিপীড়ন ও বঞ্চনাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়ে নীরব নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করেননি। সাঁওতাল ও প্রান্তিক মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা আপনি করে গেছেন। আমরা সবাই মিলে কতখানি পেরেছি, তার চেয়ে বড় কথা হলো আমাদের প্রজন্ম শত প্রতিকূলতা, প্রকাশ্য অপমান ও লাঞ্ছনা সয়েও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যখন সাঁওতালি গ্রাম জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ছারখার করা হয় গোবিন্দগঞ্জে, তিন সাঁওতালকে হত্যা করা হয়, আপনি এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। সিধু-কানু-বিরসা মুন্ডার সংগ্রামের এক সাহসী উত্তরসূরির নাম অনিল মারান্ডি।
আমি বিশ্বাস করতে চাই, অনিল মারান্ডির মতো সংগ্রামী মানুষের মৃত্যু নেই। ওই যে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন, ‘আমরা যেমন চিরকালের, সংগ্রামও তাই। কিছুই ফুরোয় না পৃথিবীতে। মুন্ডারী দেশ-মাটি-পাথর-পাহাড়-বন-নদী-ঋতুর পর ঋতুর আগমন, সংগ্রাম ফুরোয় না, শেষ হতে পারে না। মৃত্যুতে সংগ্রাম শেষ হয় না। থেকে যায়, কেননা মানুষ থাকে, আমরা থাকি।’
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী