ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার-এর ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) এনার্জি ফিন্যান্স অ্যানালিস্ট সাইমন নিকোলাসের উপসম্পাদকীয় ‘হোয়াই বাংলাদেশ শুড নট কাউন্ট অন আ ফসিল ফুয়েল ফিউচার’ আমাকে এই কলামটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জ্বালানি খাতে গত মাসের দুটো বিস্ময়কর তথ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করে সাইমন তাঁর নিবন্ধটি শুরু করেছেন; প্রথমত, ২০২০ সালের এপ্রিলের রেকর্ড মূল্যহ্রাসের তুলনায় গত জানুয়ারি মাসে এলএনজির দাম ১০ গুণ বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, গত ১২ মাসে ভিয়েতনাম বাড়ির ছাদের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে।
এই দুই অবাক করা তথ্য বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জ্বালানি–সম্পর্কিত সঠিক পথ নির্ধারণের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ববহ বিবেচনা করছেন সাইমন। কারণ, এলএনজি-সম্পর্কিত প্রথম তথ্য বাংলাদেশের প্রধানত ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচকে আগামী দিনগুলোতে প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেবে। আর ভিয়েতনামের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে গত ১২ মাসের অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জনের খবরটি চোখে আঙুল দিয়ে বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিচ্ছে, সৌরশক্তিকে প্রাধান্য দিলে কীভাবে এলএনজি-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে সক্ষম। সাইমন বলছেন, এশিয়ায় প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নির্মীয়মাণ বিদ্যুৎ প্রকল্প এলএনজির এই অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধির শিকার হয়ে পরিত্যক্ত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর। কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত যেহেতু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাই এলএনজি আমদানির মাধ্যমে তা পূরণ করা ছাড়া বাংলাদেশের বিকল্প নেই। এলএনজির দামের এ রকম নাটকীয় উল্লম্ফন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে অচিরেই সংকটে ফেলবে। আরও গুরুতর হলো, ভবিষ্যতের প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে বাংলাদেশ এলএনজি অথবা কয়লা আমদানির ওপর নির্ভর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ বাতিল ঘোষণা করায় এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এই পরিস্থিতি বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে (শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকখানি কম থাকায় এখনো লোডশেডিং তেমন বাড়েনি, কিন্তু ফাল্গুন-চৈত্র মাসে লোডশেডিং বাড়বে।)।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ওভার ক্যাপাসিটি বা অতিরিক্ত সক্ষমতা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির হারে যে প্রাক্কলন হয়েছে, তাতে মারাত্মক গলদ ছিল। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় গত কয়েক বছরে অনেক বেশি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে। আবার এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন লাইনও সম্প্রসারিত হয়নি। উপরন্তু ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হওয়ায় দেশের অনেক প্ল্যান্টকে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। আরও দুঃখজনক হলো, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তির মেয়াদ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও লবিং এবং ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এসব প্ল্যান্টের মালিকেরা সরকারের সঙ্গে তাঁদের চুক্তির মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছেন। এসব প্ল্যান্টে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৪ থেকে ১৭ টাকা, সেখান থেকে বিদ্যুৎ কিনে সরকারকে বিক্রয় করতে হচ্ছে ৭ টাকার কম দামে।
ভিয়েতনাম যেখানে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে ৯ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে, সেখানে এ দেশের ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদন এখনো ৫০০ মেগাওয়াটেও পৌঁছাতে পারেনি। বোঝা যায়, এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের অভাব রয়েছে।
এখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে গেছে, অথচ বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ৯ হাজার থেকে ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মানে, বিদ্যুতের দৈনন্দিন ব্যবহার ‘ইনস্টলড ক্যাপাসিটির’ ৪০ শতাংশের কম। ভারত থেকে যেহেতু ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে, তাই দেশের বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর ওভার ক্যাপাসিটি আরও বাড়বে। এই অবস্থায় রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি বারবার নবায়নের আসল মরতবা যে দুর্নীতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।¯
দেশের বিদ্যুৎ খাতের এই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা এবং অতিরিক্ত সক্ষমতর সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে ভিয়েতনামের মতো ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের মডেল বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার দুর্গম এলাকায় সোলার হোম সিস্টেমের সাফল্য অর্জনের দাবি করলেও আমাদের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খুব সামান্যই পাওয়া যাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ থেকে। ভিয়েতনাম যেখানে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে ৯ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে, সেখানে এ দেশের ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদন এখনো ৫০০ মেগাওয়াটেও পৌঁছাতে পারেনি। বোঝা যায়, এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের অভাব রয়েছে।
ভিয়েতনাম ছাড়াও গণচীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও জার্মানি ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। সোলার প্যানেল ও ‘ব্যাটারি’ স্থাপনে সুনির্দিষ্ট ভর্তুকি প্রদান এবং ভর্তুকি দামে ‘নেট মিটারিং’ স্থাপনে প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে এসব দেশ সাফল্য অর্জন করেছে। ‘নেট মিটারিং’ ব্যবস্থায় যেহেতু জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের মাসিক বিদ্যুৎ বিল প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায় এবং উদ্বৃত্ত সৌরবিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রয় করে আয়ও করা যায়, তাই এই ছাদভিত্তিক সোলার এনার্জি উৎপাদনকে এসব দেশে দ্রুত জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়েছে। এই ‘নেট মিটারিং’ প্রযুক্তি গণচীন থেকে এখন সুলভে আমদানি করা যাচ্ছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আমরা প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছি, যেখান থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা নাকি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। কিন্তু এই মহা বিপজ্জনক প্রকল্প বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মাঝখানে স্থাপনের দুর্বুদ্ধি কাদের মাথা থেকে এসেছে জানি না, কিন্তু এই উদ্যোগকে আমি কখনোই সমর্থনযোগ্য মনে করিনি। ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ভর্তুকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট ব্যয়ের অর্ধেক হবে না। অথচ সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিমুক্ত প্রযুক্তি। কিন্তু সৌরবিদ্যুতের এই প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে কায়েমি স্বার্থের পুঁজি লুণ্ঠন যেহেতু খুব জমজমাট হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সে জন্যই হয়তো এ দেশের ক্ষমতাসীন মহলে এই জনবান্ধব প্রযুক্তির উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যাচ্ছে না!
এলএনজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পর এখন সৌরবিদ্যুৎ তুলনামূলকভাবে আরও সস্তা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রধান অগ্রাধিকার প্রদান করুন। ২০২১ সালে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ-সুবিধায় নিয়ে আসার স্বপ্নকে টেকসই করতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পর্যায়ক্রমে জীবাশ্ম জ্বালানিকে পরিত্যাগ করে সৌরবিদ্যুৎকে প্রধান উৎসে পরিণত করতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক