অতিভক্তি কিসের লক্ষণ?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা অনেকেই এ নগরে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙিয়েছিলেন। তবে সাংসদ এম এ লতিফের টাঙানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপাদমস্তক একটি প্রতিকৃতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে নগরজুড়ে। বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে লাগানো ওই ফেস্টুনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখে অনেকেই নিশ্চিত হন এ ছবির মুখাবয়ব বঙ্গবন্ধুর হলেও শরীরটি তাঁর নয়। ফটোশপে কায়দা করে দণ্ডায়মান অন্য একজনের শরীরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুখটি শুধু জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তাহলে ছবিতে দণ্ডায়মান দেহটি কার? এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি ফেস্টুনের ছবিটি দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকেও কাছ থেকে দেখেছি। তাতে ফেস্টুনের ওই ছবির মাথার অংশটি বঙ্গবন্ধুরই। কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত শারীরিক কাঠামো সাংসদ লতিফের।’ পাঞ্জাবি ও মুজিবকোট পরা থাকলেও, ছবিতে যে ধরনের পায়জামা ও পায়ের স্নিকার দেখা যায়, তাতে এটি যে বঙ্গবন্ধুর ছবি নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। পরে অবশ্য উৎসাহীরা মুখাবয়ব বাদ দিয়ে লতিফের আসল ছবিটিও পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সাংসদ লতিফ দীর্ঘদেহী মানুষ। কিন্তু দৈহিক দৈর্ঘ্য দিয়ে যেসব উচ্চতা স্পর্শ করা যায় না, এ সত্যটি বোধ হয় তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন। বিস্মৃত না হলে বঙ্গবন্ধুর একটি আপাদমস্তক ছবি খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। এসব তৎপরতা কতটা ‘ভক্তি’র বহিঃপ্রকাশ, কতটা দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ ও সুবিধালাভের অপপ্রয়াস, তা সহজেই অনুমেয়। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিপ্রায় গোপন করারও বিশেষ চেষ্টা করেননি লতিফ। সংবাদপত্রে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে আমি প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ফুল ফিগারের (আপাদমস্তক) ছবি টাঙানোর জন্য বলেছিলাম। এটা করেছি বেনিফিট (সুবিধা) পাওয়ার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি ছাপা হলে আমি কি বেনিফিট পাব? আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। চট্টগ্রামে ফিরে ওই ছবিগুলো দেখে মন্তব্য করব।’
‘সুবিধা’ যে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তাতে কোনো রাখঢাক নেই, শুধু চট্টগ্রামে ফিরে মন্তব্য করবেন কথাটার মধ্যে নিজে এ ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত ছিলেন না, এ রকম একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। সুযোগমতো উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় কি না, সেই হিসাবনিকাশটাও মাথায় রেখেছেন। করেছেনও তাই। চট্টগ্রামে এসেই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জানিয়ে দিলেন, এটা দলের ভেতরই তাঁর প্রতিপক্ষ যারা, তাদের কাজ। তাঁকে হেয় করার জন্যই এই অপকর্ম করা হয়েছে।
দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল যেমন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, তেমনি নিজের যেকোনো ভুল উদ্যোগের দায় প্রতিপক্ষের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়াও সহজ একটি ফর্মুলা। কিন্তু ঘটনাচক্রে এই ‘ফর্মুলা’টি এখানে কার্যকর হলো না। নানা তথ্য–প্রমাণাদির কারণে লতিফ বুঝতে পারলেন প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর কাজটি সহজ হচ্ছে না। পরদিনই আবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেন তিনি। এবার হাজির করা হলো প্রেসের গ্রাফিক ডিজাইনারকে। দরিদ্র গ্রাফিক ডিজাইনারকে ‘বলি’ দেওয়া সহজতর কাজ। গ্রাফিক ডিজাইনার সর্বসমক্ষে স্বীকার করলেন ভুলটি তাঁরই। তিনিই এম এ লতিফের দেহের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বটি জুড়ে দিয়েছেন। এ অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাটিরই মতো: ‘যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর।’
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে হইচই হয়েছে যথেষ্ট। সাংসদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে। সেই মানববন্ধনে দুই পক্ষের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে’ ব্যতিক্রমী এক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রকৃত প্রতিকৃতিতে (যে ছবিটি বিকৃত করা হয়েছিল) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছে।
অতি-উৎসাহী বা ‘বেনিফিট প্রত্যাশী’ এম এ লতিফ যা করেছেন তা নিয়ে আজ নিন্দা ও ধিক্কার জানানো হচ্ছে। হয়তো তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে, কিন্তু যেকোনো সময় এ রকম ঘটনা যে ঘটতে পারে, তার ক্ষেত্র কি প্রস্তুত ছিল না? পোস্টারে-ব্যানারে জাতির জনকের ছবি ব্যবহারের কোনো নিয়ম বা বিধিনিষেধ কি আদৌ আছে? নানা অপরাধে গ্রেপ্তার, মামলার আসামি, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামের আগে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নাম ব্যবহার করে ‘নেতা’ পরিচয় দিয়ে যেসব পোস্টার, ফেস্টুন বা ব্যানার টাঙানো হয় নগরে, তাতে কি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে না বঙ্গবন্ধুর ছবি? গত পাঁচ-সাত বছরে নগরে বা নগরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির অনেক ম্যুরাল বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। অধিকাংশ দেখলে মনে হয় প্রকৃত চেহারা বা আদলের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য নেই। কোথাও কাঁচা হাতের কাজ, কোথাও বা অবজ্ঞা-অবহেলার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে উঠেছে এসব ম্যুরাল ও ভাস্কর্য। এসব দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই?

>বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে লাগানো ওই ফেস্টুনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখে অনেকেই নিশ্চিত হন এ ছবির মুখাবয়ব বঙ্গবন্ধুর হলেও শরীরটি তাঁর নয়। ফটোশপে কায়দা করে দণ্ডায়মান অন্য একজনের শরীরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুখটি শুধু জুড়ে দেওয়া হয়েছে

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রচার করা নিয়েও কোনো ধরনের সচেতনতা আছে বলে মনে হয় না। যেকোনো স্থানে, যেকোনো উপলক্ষে প্যান্ডেল টানিয়ে কোনো সভা-সমিতির আয়োজন করা হলে মাইকে বাজানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি। নির্দিষ্ট কোনো শ্রোতা-দর্শক নেই। প্রাত্যহিক ব্যস্ততা, গাড়ির হর্ন ইত্যাদি নানা কোলাহল ছাপিয়ে পথচারী বা গাড়ির যাত্রীদের কারও কারও কানে হয়তো প্রবেশ করছে কিছু কিছু শব্দ। কিন্তু কর্মব্যস্ত মানুষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায়?
এ কথা আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা-ই ছিল স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে ভাষণটি প্রচার করা হতো, সেটি রণাঙ্গনে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার মন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তেমনি ‘অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে’ গোপনে এই ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়ে উঠত স্বাধীনতাকামী মানুষ।
সম্প্রতি জ্যাকব এফ ফিল্ড নামের একজন ইংরেজ লেখক ও ইতিহাসবিদ ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্স হিস্ট্রি নামে বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এ বইটিতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জর্জ ওয়াশিংটন ও মাও সে-তুংয়ের মতো রাষ্ট্রনায়কদের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিও স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে—‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম, ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইনডিপেন্ডেন্টস’ অর্থাৎ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
সুতরাং এই ভাষণটি যখন অনাদরে-অবহেলায় বাজতে থাকে, সর্বোপরি শব্দদূষণের কারণ হয়ে ওঠে, তখন সচেতন মানুষমাত্রই ব্যথিত হন। এই কাজটি করছেন এমন একটি দলের নেতা-কর্মীরা, যাঁরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। দেখেশুনে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার পঙ্ক্তিটি মনে পড়ে—‘নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান।’
‘বেনিফিট’ পাওয়ার জন্য নিজের দেহে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়ব বসিয়ে ছাপানো ফেস্টুন টাঙিয়ে সাংসদ এম এ লতিফ যে ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য কী ব্যবস্থা তাঁর দলের নীতিনির্ধারকেরা নেবেন জানি না। তবে আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধুর ছবি, নাম, ভাষণ ইত্যাদি প্রচারের ব্যাপারে দলীয় নেতা-কর্মীদের কিছু নিয়মনীতি ও নির্দেশনা মেনে চলার বার্তা দিতে হবে দলীয় হাইকমান্ডকেই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]