বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের ২ উপধারায় প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর শপথবাক্যে লেখা আছে,
‘আমি...সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
এই শপথবাক্য উচ্চারণ করেই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। অতএব, প্রতিদিন তাঁদের ঘটা করে শপথ নেওয়ার বা অধীন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শপথ আদায় করারও প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হলো শপথ গ্রহণকালে তাঁরা যেসব ওয়াদা করেছেন, সেটি মনে রেখে কাজ করে যাওয়া। আমাদের দেশে নতুন মন্ত্রীরা শপথ নেওয়ার পর দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এক, নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে মন্ত্রীদের সংবর্ধনা, দুই. মন্ত্রীদের বিরতিহীন ওয়াদা করে যাওয়া। আবার মন্ত্রণালয়ের বাইরেও কিছু লোক সংবর্ধনা ইত্যাদির নামে নানা সুবিধা নেওয়ার তালে থাকেন।
এবারে বাইরের সংবর্ধনার চেয়ে ভেতরে সংবর্ধনার জৌলুশ বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা একটা বিষয় কিছুতেই মেলাতে পারি না, যেখানে মন্ত্রীই মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী, সেখানে তিনি কীভাবে তাঁর অধীন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা নেন? আর এসব সংবর্ধনার পেছনে বরাবরই বিশেষ মতলব থাকে। কর্মচারী ইউনিয়নের নামে সংবর্ধনা দিলে নেতাদের উদ্দেশ্য থাকে মন্ত্রীর কাছাকাছি যাওয়া, আনুকূল্য পাওয়া। একাধিক ইউনিয়ন থাকলে তো কথাই নেই। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে গালাগাল করবে। যারা মন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে দেরি করবে, তাদেরই বিএনপি-জামায়াতের লোক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। ফলে সংবর্ধনা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা চলে। একই কথা প্রযোজ্য কর্মকর্তা সমিতির ক্ষেত্রে। সেখানেও মন্ত্রীর আনুকূল্য লাভের তীব্র চেষ্টা থাকে। মন্ত্রী সদয় দৃষ্টি না দিলে জীবনই বৃথা ভাবেন। প্রতিটি সংবর্ধনা সভার গৎবাঁধা কথা হলো আপনার মতো যোগ্য, দক্ষ ও মহৎ মানুষ এই ভুবনে দ্বিতীয়টি নেই। আপনাকে পেয়ে আমরা ধন্য। ধরুন জনাব ‘ক’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁর উদ্দেশে এখন যেসব স্তুতি বর্ষিত হচ্ছে, জনাব ‘খ’ সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এলেও একই ভাষায় তাঁকে বন্দনা করা হতো। পাত্র বা মন্ত্রণালয় বদলালেও তোয়াজের ভাষা বদলায় না। আর মন্ত্রীর নিজের নির্বাচনী এলাকার নেতা-কর্মীরা মনে করেন, যেহেতু ওই এলাকার ভোটাররা তাঁকে সাংসদ নির্বাচিত করেছেন এবং সাংসদ হওয়ার সুবাদে মন্ত্রী হয়েছেন, সেহেতু মন্ত্রণালয়ের সিংহভাগ বরাদ্দ তাঁদেরই প্রাপ্য। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন না মন্ত্রী তো কোনো এলাকার নন। তিনি পুরো বাংলাদেশের মন্ত্রী। সবার সুবিধা–অসুবিধার কথা তাঁর ভাবতে হয়। কোথায় কী উন্নয়ন প্রয়োজন, কী বরাদ্দ থাকবে, সেটি ঠিক করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো সেই প্রকল্পের কাজ যাতে ঠিকমতো ও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়, সেটি নিশ্চিত করা।
৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কোনো না কোনো মন্ত্রী সংবর্ধিত হচ্ছেন। আবার সংবর্ধনার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে, ওই অঞ্চলের চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে ২৯ জানুয়ারি সংবর্ধনা দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। সংবর্ধনা দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের কোনো নজির আছে বলে জানা নেই।
খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখলাম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী টিপু মুনশির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিতির জন্য দাপ্তরিক আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ রকম সব বিভাগ ও অধিদপ্তর মন্ত্রীদের পাল্লা দিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের সংবর্ধনা দিতে থাকলে পুরো বছরটাই হয়তো কেটে যাবে। সংশ্লিষ্টদের অন্য কোনো কাজ করতে হবে না। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে সরকারি দপ্তরে দাপ্তরিক আদেশ দিয়ে মন্ত্রীকে সংবর্ধনার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা। আমরা এত দিন যেসব মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের বয়ান শুনছিলাম, সেসব মন্ত্রণালয়ে অবিশ্বাস্য দুর্নীতির খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে।
নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কেন ঘটা করে নতুন মন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেন, তার একটা কারণ নিশ্চয়ই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানতে পেরেছেন বৃহস্পতিবার ওয়াসা ভবনে গিয়ে। মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই ওয়াসার কর্মচারীরা বিক্ষোভ করছিলেন। তাঁরা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিরও অভিযোগ এনেছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, সেখানে কর্মচারীদের দুটি গ্রুপ থাকায় এ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। কর্মচারীদের মধ্যে এ রকম গ্রুপিং–লবিং সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেই আছে। আবার ঊর্ধ্বতনেরা সব সাধু পুরুষ তা–ও ভাবার কারণ নেই। আগে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা জার্সি বদল করতেন। যেহেতু এবার ভোটের মাধ্যমে সরকার বদল হয়নি, সেহেতু মন্ত্রী বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা–কর্মচারীরা আনুগত্য বদলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা যেসব কথা বলছেন, তার সারমর্ম হলো এত দিন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে পারে না। চলতে দেওয়া হবে না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসেছে, তাহলে এত দিন কীভাবে চলেছে? একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। মন্ত্রী অন্তত সাত বছর ধরে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। অথচ তিনি দুর্নীতির বাসা ভেঙেছেন বা ভাঙতে চেষ্টা করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আসনে মন্ত্রীরা আসেন, মন্ত্রীরা এক সময় চলেও যান। কিন্তু সরকারি প্রশাসন চলছে আগের নিয়মেই। সেখানে কোনো পরিবর্তন নেই। বা থাকলেও সেটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। নতুন সরকার একদিন পুরোনো হবে। মন্ত্রীরা যতই পরিবর্তনের ডাক দিন না কেন, আবার আগের মতো সবকিছু চলবে।
নতুন মন্ত্রীরা কথাবার্তা ও হাবেভাবে এটাই বোঝাচ্ছেন যে আগে মন্ত্রণালয়ে যত অনিয়ম অব্যবস্থা ও দুর্নীতি থাকুক না কেন, এখন থেকে সেসব চলবে না। এটাই তাঁদের শপথ। তাঁরা মন্ত্রণালয়ে কাজে গতি আনার কথা বলেছেন। তাঁরা বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার কথা বলছেন। সচিবেরা শপথ নিচ্ছেন বাংলাদেশকে বদলে দেবেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শপথ নিচ্ছেন বাংলাদেশকে বদলে দেবেন।
স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন আসে, টানা ১০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পর হঠাৎ করে সবকিছু নতুন করে যাত্রা শুরুর কথা এল কেন? তাহলে ১০ বছরে কি কিছুই বদলায়নি?
একশ্রেণির মানুষ আছে, নানা সংগঠনের নামে, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নামে মন্ত্রীদের সংবর্ধনা দিয়ে থাকেন। তাঁরা কাজটি করেন বিনিয়োগ হিসেবে। ভাবেন, একসময় সেটি সুদে–আসলে তুলে নেবেন। অতএব, মন্ত্রীরা ভেতরের চাটুকার এবং বাইরের মতলববাজ ও সুযোগসন্ধানীদের থেকে সাবধান থাকুন। শপথবাক্য অনুযায়ী, আপনারা কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগ দেখাতে পারেন না।
পাদটীকা: বর্তমান মন্ত্রিসভায় ৩১ জনই নতুন মুখ। পুরোনো ৩৬ জন বাদ পড়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সরকারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই পরবর্তী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। এবার তেমনটি হয়নি। কেন আগের কেবিনেটের সব বাঘা বাঘা মন্ত্রী বাদ পড়লেন, কেন ১৪ দলের শরিকদেরও মন্ত্রিসভায় রাখা হলো না, সেসব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা আছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, নতুনদের মন্ত্রী বানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরেকটি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। আবার কারও মতে, ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। ১৯৯৬ সালে ছিল ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ সরকার। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার। এবার ‘শতভাগ আওয়ামী লীগ সরকার’ কী করে সেটাই দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com