চার দশকজুড়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নানা মাত্রাকে অবিরাম খুঁড়ে দেখার একটা অব্যাহত চেষ্টা আছে। সেই অব্যাহত যাত্রায় এখনো আবিষ্কৃত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের এমনই অনেক অপ্রত্যাশিত দিগন্ত। এ বছর আমি নিজে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এমন দুটো অজানা তথ্য পেয়ে চমত্কৃত হয়েছি। দুটোই দেশের বাইরে ভিন্ন ধারার মুক্তিযুদ্ধের উদ্যোগের চমৎকার উদাহরণ। দুটোই ঘটেছে আমেরিকার মাটিতে, যে দেশের সরকার ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।
প্রথম উদ্যোগটি সে সময় আমেরিকাপ্রবাসী প্রখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের। রবিশঙ্কর যে বিটলসের গায়ক জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেছিলেন, সে খবর বহুল প্রচারিত। কিন্তু এই খবরটি অনেকটাই অজানা যে এই কনসার্ট আয়োজনের আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সংহতি জানিয়ে রবিশঙ্করের প্রথম উদ্যোগ ছিল ‘জয় বাংলা’ নামে একটা গানের রেকর্ড প্রকাশ করা। নিজের লেখা ও সুর করা দুটো গান, সেই সঙ্গে একটা সেতার, সরোদ, তবলার যুগলবন্দী রেকর্ড করেছিলেন তিনি ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের আগে। যদিও সে রেকর্ড রিলিজ হয়েছিল কনসার্টের পর। এই রেকর্ডটাই ছিল রবিশঙ্করের ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্ট আয়োজনের প্রথম ধাপ। সেই রেকর্ড এখন দুর্লভ। আমার সেই রেকর্ডটা শোনার সৌভাগ্য হলো কলকাতার বিশ্বভারতীর ভাষাতত্ত্ববিদ এবং সংগীত সংগ্রাহক রাজীব চক্রবর্তীর সুবাদে। রবিশঙ্কর আত্মজীবনী ‘রাগা মালা’তে তাঁর এই ‘জয় বাংলা’ রেকর্ডটার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১৯৭১-এ যখন তিনি হলিউডের হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউতে ছিলেন, তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খোঁজ পান। তিনি পত্রপত্রিকায়, টিভিতে দেখতে পান যুদ্ধের হত্যাযজ্ঞ, শরণার্থীদের মিছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিতে থাকেন বাংলাদেশে। স্মরণ রাখা দরকার তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই বাংলাদেশেরই। তাঁর গুরু সংগীত ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁও বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। রবিশঙ্কর আত্মজীবনীতে লিখেছেন বাংলাদেশের এই যুদ্ধ যেন তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ। তিনি জানতে পারলেন তাঁর অনেক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও মানবেতর জীবন যাপন করছে শরণার্থীশিবিরে। তাঁর মনে হলো এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে একটা গানের অ্যালবাম করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর মূল অনুপ্রেরণা ছিল ভাষা। বাংলা তাঁর নিজের ভাষা। তিনি বাংলাতেই একটা গানের অ্যালবাম করলেন। লিখে ফেললেন দুটো বাংলা গান, সুর দিলেন তাতে। দুর্লভ রেকর্ড প্লেয়ারে ততোধিক দুর্লভ রবিশঙ্করের কথা ও সুরে সেই গান শুনি:
ও ভগবান খোদা তালা
মোদের ছেড়ে কোথায় গেলা
কত মরল কেই বা গোনে
মোদের কান্না কেই বা শোনে
আর কত বলো সইব ঠেলা
ও ভগবান খোদা তালা
মোদের ফেলে কোথায় গেলা...
এই গানের সুরে এক আশ্চর্য কান্না জড়িয়ে আছে যেন। খুব ভেতরের তন্ত্রী থেকে ছিঁড়ে আসা এই সুর। বাংলাদেশের মাটি, ভাষার প্রতি গভীর মায়া যেন চুইয়ে পড়ে গানটির প্রতিটি লাইনে। আরও অবাক হই যখন জানতে পারি, গানটি গেয়েছেন রবিশঙ্কর এবং অন্নপূর্ণা দেবীর একমাত্র সন্তান শুভেন্দু শঙ্কর। বোঝা যায়, বিদেশে বড় হওয়া শুভেন্দুর বাংলা ভাষা বিশেষ আয়ত্তে নেই, কিন্তু কণ্ঠে অপরিসীম মায়া এনে তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন সেই সীমাবদ্ধতা। এই রেকর্ডের অন্য গানটি কোরাস, এই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছেন প্রখ্যাত তবলাবাদক শঙ্কর ঘোষের স্ত্রী সংযুক্তা ঘোষ।
রেকর্ডটি প্রকাশ করেছিল আমেরিকার অ্যাপল রেকর্ড এবং তার অর্থ জুগিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। এই রেকর্ডের সূত্র ধরেই পরে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের সাহায্যার্থে আরও বড় আকারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন।
দ্বিতীয় উদ্যোগটিও আমেরিকায়। ফিলাডেলফিয়ার কিছু স্থানীয় মানুষ মিলে ’৭১-এ এক ব্যতিক্রমী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে। আমেরিকার নিক্সন সরকার তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের অস্ত্রসহ সব রকম সহায়তা দিয়ে আসছে। ফিলাডেলফিয়ার সেই বাসিন্দারা পত্রিকা মারফত জানতে পারেন নিকটবর্তী বাল্টিমোর বন্দরে একটি পাকিস্তানি জাহাজ আসছে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করতে, যে অস্ত্র ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন এ জাহাজকে তাঁরা কিছুতেই ভিড়তে দেবেন না বাল্টিমোর বন্দরে।
কিন্তু তাঁরা নেহাতই নিরীহ, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, তাঁরা কী করে ঠেকাবেন তাঁদের সরকারের এই বিশাল পাঁয়তারা? তাঁরা বন্দরে জাহাজ ঢোকার মুখে অগণিত ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে একটা দেয়াল তৈরি করবেন বলে ঠিক করলেন, যাতে সেই জাহাজ বন্দরে ঢুকতে না পারে। তাঁরা স্থানীয় বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসী বাঙালিরা তখন ‘ফ্রেন্ডস অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটা সংগঠন তৈরি করেছেন। সেই প্রবাসী বাঙালিরা যুক্ত হলেন এই আমেরিকান দলটির সঙ্গে। পাকিস্তানের সেই জাহাজ বাল্টিমোরে ভেড়ার তারিখের আগেই নানা অঞ্চল থেকে তাঁদের গাড়ির ছাদে নিজেদের ছোট ছোট নৌকাগুলো নিয়ে তাঁরা হাজির হয়ে যান বাল্টিমোর বন্দরে। পত্রিকা ও টিভিকেও তারা জানিয়ে দেন।
পাকিস্তানের সেই জাহাজ বাল্টিমোর বন্দরের মুখে আসে ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই। ৩০-৩৫ জনের একটা দল তাদের ছোট ছোট নৌকা দিয়ে সেদিন পানির ওপর তৈরি করে একটা দেয়াল। বিশাল যুদ্ধজাহাজ ঠেকানোর জন্য ক্ষুদ্র নৌকাগুলো নেহাত অকিঞ্চিৎকর তবু তারা অদম্য মনোবলে পথ আগলে রাখে সেই জাহাজের। পুলিশ তাদের মাইক দিয়ে সরে যেতে বলে, বলে না সরলে জাহাজ তাদের ওপর দিয়েই চালিয়ে নেওয়া হবে এবং তার পরিণতির ভার পুলিশ বহন করবে না; কারণ তারা যা করছে তা বন্দর আইনের বিরোধী। কিন্তু সেই নৌকাদল নড়ে না একচুল। আগে খবর দেওয়াতে পত্রিকা, টিভির সাংবাদিকেরা ভিড় জমান সেখানে। একপর্যায়ে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু পত্রিকা, টিভির সুবাদে এ ঘটনা পায় ব্যাপক প্রচারণা। অস্ত্র চালানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ হয়। একপর্যায়ে সেই পাকিস্তানি জাহাজ অস্ত্র ছাড়াই বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এভাবেই এক অভূতপূর্ব উপায়ে হাজার মাইল দূরের অগণিত মানুষের জীবন বাঁচালেন ফিলাডেলফিয়ার অধিবাসীরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা রিচার্ড টেইলরের লেখা বই ব্লকেড-এর ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন আরিফ ইউসুফ ও তাসবীর ইমাম। সঙ্গে ছিলেন মৃদুল চৌধুরী, রশীদ মামুন, সুজন বিন ওয়াদুদ। এই ব্যতিক্রমী প্রামাণ্যচিত্রটির অল্প কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে ঢাকায়। পুরো ছবিটি দেখার সুযোগ আমার হয়নি কিন্তু এর ট্রেলারে একটা বিশাল জাহাজকে ঘিরে থাকা ছোট ছোট নৌকার দেয়ালের দৃশ্য আপ্লুত করেছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এমনি অগণিত ক্ষুদ্র অথচ অমিত সাহসী উদ্যোগে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। বিজয়ের মাসে স্মরণ করি সেই সব টুকরো মুক্তিযুদ্ধগুলোকে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক
[email protected]