শুধু কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গই এখন তৃণমূলী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে। এই আক্রমণ ভারতের ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিলের প্রতিবাদে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে তৃণমূলের দুই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাপস পালের গ্রেপ্তারের ঘটনা। সব মিলিয়ে তাই উত্তপ্ত কলকাতা, উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ।
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলের নেতা। আর তাপস পাল নামী চিত্রতারকা। এই দুই গ্রেপ্তার আর সারদা-নারদা-রোজভ্যালিকাণ্ডে সম্প্রতি নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মঞ্চ এখন সরগরম। রোজই চলছে নোটবিরোধী মিছিল-সমাবেশ আর দুই সাংসদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অবস্থান ধর্মঘট, প্রতিবাদ সমাবেশ। আর এতে করে উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। ইতিমধ্যে এই আন্দোলন আবার পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাজধানী নয়াদিল্লি, ভুবনেশ্বর, আগরতলা, বিহার আর পাঞ্জাবে।
গত ৮ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের কালোটাকা উদ্ধার আর সন্ত্রাসীদের কার্যক্রমে রাশ টানতে ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল করলে প্রতিবাদের প্রথম আগুন জ্বালিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবাদের সুর চড়িয়ে ঘোষণা দেন, এটা মানা যায় না। মানব না। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে। নোট বাতিল করে গরিবদের পথে বসানো চলবে না। শুরু হয় মমতার ডাকে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নোটবিরোধী আন্দোলন। মমতা স্লোগান তোলেন—‘দেশ বাঁচাও, মোদি হটাও’। আগুন জ্বলে ওঠে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। মমতা দাবি করেন, এই নোট আন্দোলনের শিকার হন ১২০ জন। নোট বদলাতে আর টাকা তোলার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান ওই মানুষেরা। এতেও টনক নড়েনি প্রধানমন্ত্রী মোদির। এতে মমতা নোটবিরোধী আন্দোলনের সুর চড়িয়ে একহাত নেন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে। মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, তাঁকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন বারবার। মমতার এই অশালীন মন্তব্যকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। উত্তপ্ত হয় রাজনীতি।
>তিনটি আর্থিক দুর্নীতিকাণ্ডে জেরবার তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আজ এতই বিক্ষুব্ধ যে তাঁরা এখন দেশব্যাপী নোটকাণ্ড আর দলীয় সাংসদদের গ্রেপ্তারকাণ্ডকে অস্ত্র করে মাঠে নেমে পড়েছেন। স্লোগান তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে
এরপরই রাজনীতিতে আসে নতুন চমক। দীর্ঘদিন হিমঘরে থাকা রোজভ্যালি দুর্নীতি মামলার তদন্তকাজ সচল হয়ে পড়ে। সিবিআই বা ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো নতুন করে শুরু করে রোজভ্যালি দুর্নীতি মামলার তদন্ত। খেপে যায় তৃণমূল। অভিযোগ তোলে, এটা মোদির রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নতুন এক হাতিয়ার। নোটবিরোধী আন্দোলনকে দমানোর ষড়যন্ত্র। এই রোজভ্যালিকাণ্ডের সঙ্গে আগেভাগেই জড়িয়ে ছিলেন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সাংসদ, মন্ত্রী, বিধায়ক। কিন্তু এসব আন্দোলনকে তোয়াক্কা না করেই সিবিআই তদন্তে নামে। জেরা করে তৃণমূলের দুই সাংসদ তাপস পাল ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারপর জেরার মধ্যেই এই দুই সাংসদকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করে। এখন এই দুই সাংসদ ওডিশার রাজধানী ভুবনেশ্বরের কারাগারে। দুজনেরই জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন ভুবনেশ্বরের সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত।
কিন্তু কেন হলো এমনটা? তাই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে জল্পনা-কল্পনার অভাব নেই। কেউ কেউ বলছেন, নোট বাতিল ইস্যুতে মমতা অতিসক্রিয় হওয়ায় এবং মমতার প্রধানমন্ত্রী মোদিকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যের ফসল এটি। তা না হলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সারদা বা রোজভ্যালিকাণ্ড নিয়ে কম পানি গড়ায়নি। পানি গড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি মনে করেন, বিভিন্ন বিল পাস করাতে মমতার সাহায্য নিতে হবে। বিশেষ করে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায়। নিম্নকক্ষ লোকসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও রাজ্যসভায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সে ক্ষেত্রে তাদের মমতার সাহায্যের প্রয়োজন হবে। কারণ, কংগ্রেস বিজেপির শত্রুপক্ষ। অন্যদিকে মমতার ঘাড়ে ঝুলছে সারদা, নারদা ও রোজভ্যালি মামলা। আর আশঙ্কা, এতে করে ফেঁসে যেতে পারেন তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক। রাজনৈতিক মহলের দাবি, বিজেপি ও তৃণমূলের এই দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের জন্য গোপনে নাকি আঁতাতও হয়। এরপরই দেখা যায় সারদা, রোজভ্যালিকাণ্ডের তদন্ত শ্লথ হয়ে পড়ে। মমতার সমর্থন নিয়ে বিভিন্ন বিলও পাস করাতে সক্ষম হন মোদি।
সত্যি কথা কি, দ্বিতীয় মেয়াদে ভালোই চলছিল মমতার রাজত্ব। চাপ ছিল না সারদা, নারদা, রোজভ্যালিকাণ্ডের। কিন্তু সবকিছু উল্টে যায় নোট বাতিলের পর। মমতা নোট বাতিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই প্রতিবাদমুখর হন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। আর এর ফলেই রাজনৈতিক অঙ্গনের পানি ঘোলাটে হতে শুরু হয়। দুই মেরুতে চলে যায় বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস। শুরু হয় একের বিরুদ্ধে অন্যের পাল্টাপাল্টি চ্যালেঞ্জ। কাদা-ছোড়াছুড়ি। এদিকে বসে নেই বিজেপিও। তারাও মমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। ঘোষণা দিয়েছে, এভাবে পশ্চিমবঙ্গকে অশান্ত করে তুললে তারা পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানাতে বাধ্য হবে। কারণ, রাজ্যের মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম ফাঁস হয় সারদা চিটফান্ডকাণ্ড। আড়াই হাজার কোটি রুপির এই আর্থিক দুর্নীতিকাণ্ডে সেদিন গ্রেপ্তার হন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। আরও গ্রেপ্তার হন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, সাংসদ সঞ্জয় বসুসহ আরও কয়েকজন নেতা। আরেকটি চিটফান্ড রোজভ্যালিকাণ্ড ফাঁস হয় ২০১৪ সালে। প্রায় ১৭ হাজার কোটি রুপির এই কাণ্ডে গ্রেপ্তার হন রোজভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু। আর সম্প্রতি সেই কাণ্ডে গ্রেপ্তার হলেন তৃণমূলের দুই সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস পাল। অন্যদিকে নারদাকাণ্ড ফাঁস হয় গত বছরের মার্চ মাসে। এটা ছিল তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের গোপন ক্যামেরার সামনে ঘুষ গ্রহণের দৃশ্য। পশ্চিমবঙ্গের গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৪ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একদল নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। এই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা, সাংসদ, মন্ত্রী, বিধায়কের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা।
আর এই তিনটি আর্থিক দুর্নীতিকাণ্ডে জেরবার তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আজ এতই বিক্ষুব্ধ যে তাঁরা এখন দেশব্যাপী নোটকাণ্ড আর দলীয় সাংসদদের গ্রেপ্তারকাণ্ডকে অস্ত্র করে মাঠে নেমে পড়েছেন। স্লোগান তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে। চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা। তৃণমূলের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।