গত সপ্তাহে ওয়াজিরাবাদে যে ঘটনা ঘটে গেল, সম্ভবত সেটা আগের কোনো গল্পেরই পুনরাবৃত্তি। ইমরান খানের ওপর বন্দুক হামলা পুরো দেশকে গভীর নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সন্দেহভাজন হামলাকারী গ্রেপ্তার হলেও হামলার উদ্দেশ্য এখনো রহস্যাবৃত থেকে গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দায়ী করেছেন। তিনি তাঁদের নামও উল্লেখ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ইমরান সেনাসদর দপ্তরের বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ হামলা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বারুদের জোগান দিয়েছে। তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পাকিস্তান তাদের চলমান লংমার্চ কর্মসূচিতে এ ঘটনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
একটি সংকটময় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর পিটিআইয়ের তরফে চাপ তৈরি করার ব্যাপারটি হিসাব-নিকাশ করেই করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা চিঠিতে ইমরান ‘ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন’-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইমরান তাঁর চিঠিতে পাকিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল করে দিচ্ছে যেসব ‘গুরুতর অন্যায় কাজ’, সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলেন।
প্রেসিডেন্টের কাছে ইমরানের এ আবেদন গত মাসে সেনাসদর দপ্তরের পক্ষ থেকে করা সংবাদ সম্মেলনেরই পাল্টা পদক্ষেপ। ইমরানের ক্ষমতা হারানোর পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করার নিন্দা জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনটি থেকে। দুই পক্ষের মধ্যকার এ স্থবির সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আজম সোয়াতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গোয়েন্দা হেফাজতে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ এই সিনেট সদস্যকে বিতর্কিত টুইটের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
এরই মধ্যে আজম ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একটি আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ হয়েছে, যা রাজনৈতিক বিভাজনের এই সময়ে জনরোষ তৈরি করেছে। আইনসভার একজন সম্মানিত সদস্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভিডিও ধারণ ও তা প্রকাশের চেয়ে অশুভ ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। এ ঘটনার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর দিকেই আঙুল উঠেছে।
হত্যাচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে ইমরান সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধ তীব্র করে তুলেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলেছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ‘চূড়ান্ত অর্থে অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে সতর্ক করে দিয়েছে তারা। সরকারের কাছে সেনাবাহিনীর দাবি, এ ধরনের কুৎসা রটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলো ভেঙে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এভাবে ভেঙে পড়ার অর্থ হলো ব্যাপক সংঘাত ও হানাহানির জন্ম। রাজনৈতিক সহিংসতা ও মেরুকরণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপথে নিয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি করছে। সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান খানের এই দ্বন্দ্ব বেসামরিক নাগরিকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। এটা ক্ষমতার নিষ্ঠুর লড়াই। কোনো সমাধানসূত্র দেখা যাচ্ছে না, পাকিস্তান খুব দ্রুতই একটি নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রকাশ্যে এ ধরনের রেষারেষি খুব বিরল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাবেক পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে বৈরিতা যে ক্রমে বেড়ে চলেছে, সেই বিষয়ই স্পষ্ট করছে তা। সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইমরানের এই আগ্রাসী মনোভাবের অর্থ হচ্ছে জেনারেলদের সঙ্গে কোনো ‘পর্দার অন্তরালের আলোচনা’ করতে রাজি নন তিনি। জনগণের মধ্যে ইমরানের যে ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন, সেটাই তাঁর ঔদ্ধত্যের কারণ।
এ ছাড়া বিরোধী দলে থেকেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের ক্ষমতায় রয়েছে পিটিআই। বিশেষ করে পাঞ্জাবে জোট সরকারে থাকায় পিটিআই রাজনৈতিকভাবে বিশাল সুবিধা পাচ্ছে। এ কারণেও সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে পিটিআই যেসব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, তা মোকাবিলা করা বেশ কঠিন।
তবে হত্যা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব ও সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা সম্ভব নয়। কেননা, এর বিরোধিতা আসবে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই। সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া পারভেজ এলাহির পক্ষে কঠিন। ইমরান খানের সব প্রচেষ্টার পরও প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নিতে রাজি হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর ঘটনাস্থল থেকে যে বন্দুকধারীকে আটক করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে পুলিশ। সেনা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইমরানের ক্ষমতার গণ্ডি কতটুকু, তা নিয়ে এটা একটা স্পষ্ট বার্তা। কিন্তু এটাও সত্য যে তাতে ইমরানের উত্থান ঠেকানোও সম্ভব নয়।
এর মধ্যে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ এসেছে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কাছ থেকে। ওয়াজিরাবাদের ঘটনার সত্যানুসন্ধান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে পূর্ণ বেঞ্চ কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। তবে বিচার বিভাগীয় কমিশন চান ইমরান। আবার এটাও সত্য যে বিচার বিভাগীয় কমিশনের রায় বিপক্ষে গেলে সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে না তাঁর কাছে।
ইতিমধ্যে ঘটনার পর কয়েক দিন স্থগিত থাকার পর আবার তাঁর লংমার্চ কর্মসূচি শুরু করেছেন ইমরান। পাঞ্জাবের প্রধান প্রধান শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আশা খুব কম। ইসলামাবাদে লংমার্চ পৌঁছাতে আরও কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্যে পিটিআইয়ের সমর্থকেরা রাজধানীর প্রবেশদ্বারগুলো অবরোধ শুরু করে দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্টকে লেখা ইমরান খানের চিঠি পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যকার ফাটলের বহিঃপ্রকাশ। গত এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ সেই ফাটল নগ্নভাবে বের হয়ে এসেছে। একটি ক্রমবর্ধমান বিভাজিত রাষ্ট্রক্ষমতার ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি করে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলো ভেঙে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এভাবে ভেঙে পড়ার অর্থ হলো ব্যাপক সংঘাত ও হানাহানির জন্ম। রাজনৈতিক সহিংসতা ও মেরুকরণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিপথে নিয়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি করছে। সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে ইমরান খানের এই দ্বন্দ্ব বেসামরিক নাগরিকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। এটা ক্ষমতার নিষ্ঠুর লড়াই। কোনো সমাধানসূত্র দেখা যাচ্ছে না, পাকিস্তান খুব দ্রুতই একটি নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
● জাহিদ হোসেন পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক