নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে হুতিরা লোহিত সাগরে জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যুদ্ধজাহাজ পাঠায়। হুতি বিদ্রোহীদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করতে এবং বিপদে পড়া বাণিজ্যিক জাহাজ উদ্ধারে সহযোগিতা করার কাজে সবচেয়ে সেরা যুদ্ধজাহাজ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটিশরাও এ জন্য তাদের সেরা যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে।
যাহোক, পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন হুতির সামরিক স্থাপনায় হামলা শুরু করেছে।
হুতি বিদ্রোহীরা যেভাবে একের পর এক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে, তাতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয় দেশের মধ্যেই সংশয় তৈরি হয়, এ ধরনের হামলা ঠেকাতে তাদের যুদ্ধজাহাজগুলো কতটা কুলিয়ে উঠবে। ১০ জানুয়ারি মার্কিন ও ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলো ২১টি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করে। সে সময়ই ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শাপস বলেন, ‘এটা টেকসই সমাধান নয়।’ তাঁর এই কথার মানে কী আসলে?
প্রশ্ন হলো, হুতি পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল? এ প্রশ্নের সম্ভাব্য দুটি উত্তর রয়েছে। প্রথম উত্তর হলো, একটা যুদ্ধজাহাজ খুব কমসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজে এজিস ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। এ জাহাজগুলো এসএম-২ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে।
যুক্তরাষ্ট্র অথবা ব্রিটিশ জাহাজের কোনোটার পক্ষেই সমুদ্রে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হলো, দীর্ঘ সময় ধরে ‘লড়াই চালিয়ে’ যাওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের নেই।
১০ জানুয়ারি হুতির হামলা থেকে এই ইঙ্গিত মিলছে যে সামনের দিনগুলোতে হুতির হামলার সংখ্যা আরও বাড়বে। হুতির অস্ত্রভান্ডার যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নিরাপত্তা সক্ষমতার ওপর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রতিটি এসএম-২ ক্ষেপণাস্ত্রের পেছনে খরচ হয় ২ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। আর ব্রিটিশ বাহিনী যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, তার প্রতিটির জন্য ১ থেকে ২ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত খরচ করতে হয়।
আবার এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত একবার ফুরিয়ে গেলে শূন্যস্থান পূরণ করাও অনেক চ্যালেঞ্জের। এখানে শুধু খরচের প্রশ্ন নয়, সেগুলো উৎপাদনের জন্য কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে পারে।
লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুয়েজ খালের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মিসর। প্রতি মাসে সুয়েজ খাল থেকে মিসর রাজস্ব আয় করে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার।
এখন দ্বিতীয় উত্তরে আসা যাক। কী এমন ঘটল, যা আগের চেয়ে ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাব্য কারণ আছে।
প্রথমটি হলো, ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডায়মন্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের রণতরি সমুদ্রের যে এলাকায় রয়েছে, সেখানে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে। এই ভাষ্য যদি সত্য হয়, তাহলে এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের রণতরি লক্ষ্য করে সরাসরি হামলা করেছিল হুতিরা।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে হুতির হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার জবাব। ২০ ডিসেম্বর হুতির নেতৃত্ব হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, আক্রান্ত হলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজে হামলা করবে।
৩১ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের কনটেইনারবাহী জাহাজে হামলা চালায় হুতিরা। জাহাজটি থেকে পাঠানো উদ্ধার বার্তায় বলা হয়, চারটি নৌকা তাদের ঘিরে রেখেছে। ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে বলা হয়, ‘ইয়েমেনের হুতিনিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ছোট নৌকাগুলো আসে। গুলিবর্ষণ করে। জাহাজটির ২০ মিটারের কাছে নৌকাগুলো চলে আসে এবং জাহাজে ওঠার চেষ্টা করে।’
হুতির নৌকাগুলো থেকে কনটেইনারবাহী জাহাজ রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের যুদ্ধজাহাজ থেকে হেলিকপ্টার পাঠায়। সরে যাওয়ার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করলে তাতে আক্রমণ চালায়। এতে হুতিদের তিনটি নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়। পালিয়ে যায় একটি।
হুতির পক্ষ থেকে বলা হয়, মার্কিন শত্রুদের তাদের অপরাধের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে। লোহিত সাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কোনোভাবেই ইসরায়েলের জাহাজকে সুরক্ষা দিতে পারবে না।
তৃতীয় কারণটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ১০ জানুয়ারির হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধজাহাজ লক্ষ্য করে জাহাজ-বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে হুতিরা। এর আগে, হুতিরা কামিকেজ ড্রোন ও জাহাজ-বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
ড্রোন খুব ধীরে ওড়ে। হুতির কাছে চার ধরনের যুদ্ধ ড্রোন আছে। কাসেফ-১, কাসেফ-২, সামাদ-২ ও সামাদ-৩।
কাসেফ-১ ও কাসেফ-২ ড্রোন দুটি ইরানের আবাবিল ড্রোনের সংস্করণ। স্বল্পপাল্লার এই ড্রোন ৩০ কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। সামাদ ড্রোন দূরপাল্লার। বাব-এল-মান্দেব প্রণালিতে জাহাজ আক্রমণে যে ড্রোন ব্যবহার করেছে হুতিরা, সেগুলো স্বল্প পাল্লার ড্রোন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ইয়েমেনের হুতিদের হাতে কয়েক ধরনের জাহাজ-বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর নরওয়ের একটি জাহাজে এ ধরনের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়। জাহাজটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুতগতির। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় কম পাওয়া যায়।
ইরানের কাছ থেকে হুতিরা কয়েক ধরনের জাহাজ–বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে। এর ফলে তটরেখা ধরে সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে গভীর সমস্যা তৈরি করছে। বাব–এল-মান্দেব প্রণালিতে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে এটি মূল সমস্যা।
হুতিরা জাহাজ-বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে সরে এসে হুতিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে।
আরেকটি বিকল্প সম্ভাবনা হলো, লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুয়েজ খালের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মিসর। প্রতি মাসে সুয়েজ খাল থেকে মিসর রাজস্ব আয় করে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত