সব সময় তারা সরব হন না। সরব হন তখনই, যখন কেউ ইসরায়েলে হামলা চালায়। পশ্চিমা মানবাধিকারকর্মীদের এই অদ্ভুত ও একপেশে আচরণ নতুন নয়।
গত সপ্তাহজুড়ে হিজবুল্লাহর দমনের নামে যখন ইসরায়েল লেবাননে বেপরোয়া হামলা চালাচ্ছিল, তখন তারা চোখ বন্ধ করে মুখে কুলুপ এঁটেছিল।
লেবাননে টানা কয়েক দিন বিমান থেকে নির্বিচার বোমা হামলার পর দেশটিতে ঢুকেছেন ইসরায়েলের সেনারা।
ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে ঢোকার পর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে শুধুই আহ্বান, কোনো জোরালো প্রতিবাদ নয়। তবে ইসরায়েলের দিকে তাক করে ১ অক্টোবর, ইরানের রকেট হামলার পর, সবাই নড়েচড়ে বসেছে। সবাই ইরানের নিন্দায় সরব হয়েছে।
ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও সর্বশেষ লেবাননে হামলার পর ওই অঞ্চলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে হামলার পর সব সময় ইসরায়েল বলে থাকে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে এই আক্রমণ।
কিন্তু ইসরায়েলের এই আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের শেষ কোথায়! সরা পৃথিবী বিষয়টি অসহায়ভাবে দেখছে।
গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ১৮১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর থেকে ইসরায়েলের আদি অকৃত্রিম মিত্র ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র, ইরানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করছে।
এই প্রথম ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা হয়েছে এবং ইরানের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ এখনো শেষ না হতেই ইসরায়েলিরা দ্বিতীয় যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলেছে। ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে সীমান্ত অতিক্রম করছে।
লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ একটি ‘সীমিত স্থল আক্রমণ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
১৯৮২ সালে, ইসরায়েল লেবাননে একটি ‘সীমিত’ আক্রমণের কথা বলেছিল এবং দুই দিন পরেই ইসরায়েলি সৈন্যরা লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থান নিয়েছিল।
ইসরায়েল সেই সময় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ভেঙে দিতে বৈরুত দখল করেছিল। পরবর্তী সময়ে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) না থাকলেও হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া লেবানন থেকে গড়ে ওঠে।
এই মুহূর্তে হিজবুল্লাহ কেবল ইসরায়েল সীমান্তের একটি মিলিশিয়া বাহিনী নয়; বরং ভঙ্গুর লেবানন রাষ্ট্রের কয়েকটি স্তম্ভের একটি।
আর এবার ইসরায়েল গাজা, লেবানন ও ইয়েমেনে-ইরানের মিত্র মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে।
যাদের সমারাস্ত্রে আজ যে ইসরায়েলের বাহুবল, সেই রাষ্ট্রগুলোর নেতারা ও তাদের জোটগুলো ১ অক্টোবর ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর থেকে মুখ খুলেছেন।
জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন যে তিনি ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। চ্যান্সেলর বলেন, ‘ইরান পুরো অঞ্চলে আগুন লাগানোর ঝুঁকি নিয়েছে, এটি যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।
ইসরায়েলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সম্ভাব্য কঠোরতম ভাষায় নিন্দা করা উচিত।’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্যারিসে বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ফরাসি সৈন্য ও সামুদ্রিক ইউনিটকে একত্র করেছেন; যাতে তেহরানকে তার অবস্থানের মধ্যেই আটকে রাখা যায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলে রকেট হামলা প্রতিহত করতে আমেরিকান নৌবহর ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইরানের এই হামলা ‘অগ্রহণযোগ্য’।
বর্তমানে মেক্সিকোতে অবস্থানরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারে ইইউর প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে।
একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
শিল্পোন্নত সাত দেশের জি-৭ জোটে প্রেসিডেন্ট ইতালির পক্ষ থেকেও সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর নবনির্বাচিত প্রধান মার্ক রুট্টে বলেছেন, লেবাননের চলমান ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি।
তাঁর আশা যত দ্রুত সম্ভব এই সংঘাত থেমে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর বিষয়ে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি। তিনি বলেছেন, আঞ্চলিক যুদ্ধ হলে তার চড়া মূল্য দিতে হবে।
তবে ইউরোপে কেবল আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম বা স্পেন ইসরায়েলের এই লাগামহীন আগ্রাসনকে সমর্থন করেছেন না।
অন্যদিকে মস্কোতে ইরানের মিত্র রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সব পক্ষকে সংঘাত না বাড়াতে আহ্বান জানাচ্ছে, ‘সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে’ বলে তিনি জানান।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট রোন্ডসু পত্রিকাটিতে ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওলিভার রায়, একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে, ইসরায়েলিরা এখন নিয়ন্ত্রণের খেলা খেলছে।
তারা কোনো দেশের সার্বভৌম বা লাল রেখাকে সম্মান করে না। ইসরায়েলিরা গাজায় হামাসকে ধ্বংস করতে সফল হয়নি; কিন্তু তারা তার সামরিক সক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ইসরায়েলিরা থামবে না।
বিশেষ করে তাদের গোয়েন্দারা উচ্চ পর্যায়ে ইরান এবং হিজবুল্লাহ উভয় জায়গায় অনুপ্রবেশ করেছে। তারা ইরানিদের প্রাচীরের বিরুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে, ইসরায়েলিদের হাতে সম্ভবত কিছু ভালো কার্ড আছে।
তারা সম্ভবত ইরানের কিছু পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম। ইসরায়েল, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের শাসন সম্পর্কে সবকিছু জানে।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানিদের মধ্যে একটি নৈতিক সংকট রয়েছে। তারা সম্ভবত অর্থের বিনিময়ে ইসরায়েলের পক্ষে গোয়েন্দা হয়েছে।
যদিও সেই ঐক্য, শক্তি ও সামর্থ্য তাদের নেই। আবার ইসরায়েলের কট্টরবাদীরা নীলনদ থেকে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত একটি বৃহত্তর ইসরায়েলের স্বপ্ন দেখছে। আর তা নিয়েই চলেছে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। বিষয়টি নিয়ে মীমাংসার কোনো উদ্যোগ নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের কট্টরবাদীরা ইসলামপন্থীরা ইসরায়েলের ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী অনেক আগে থেকেই করে আসছেন।
যদিও সেই ঐক্য, শক্তি ও সামর্থ্য তাদের নেই। আবার ইসরায়েলের কট্টরবাদীরা নীলনদ থেকে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত একটি বৃহত্তর ইসরায়েলের স্বপ্ন দেখছে।
আর তা নিয়েই চলেছে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। বিষয়টি নিয়ে মীমাংসার কোনো উদ্যোগ নেই।
আছে কেবল হুংকার আর পশ্চিমাদের মানবাধিকার বা শান্তিবাদী নীতি আছে শুধু কাগজে-কলমে। তাদের তথাকথিত সেই সব নীতি বোধ কেবলই তাদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
তাই নিজেদের স্বার্থের সংকট না হওয়া পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে রাখা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানির প্রতিনিধি
[email protected]