এক যে ছিল রাজা। রাজার ভারি অসুখ। যায় যায় অবস্থা। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। বদ্যি বলল, ‘সুখী মানুষের জামা এনে রাজার গায়ে পরিয়ে দাও। ব্যারামের আরাম হবে।’
রাজার লোক সুখী মানুষের তালাশে বেরোল। তারা যার কাছে যায়, সে-ই বলে, তার দুঃখের শেষ নাই; তার এই সমস্যা, সেই সমস্যা।
শেষে নেংটি পরা এক লোককে পাওয়া গেল। সে বলল, তার কোনো দুঃখ নাই। সে বিরাট সুখী মানুষ।
রাজার লোক বলল, ‘তোর জামাটা নিয়ে আয়, লাখ টাকা দেব।’ লোকটা বলল, ‘কেমনে জামা আনব? আমার তো কোনো জামা নাই।’
গল্পটার এইটুকু আমরা সবাই জানি। পরেরটুকু জানি না। পরেরটুকু হলো: রাজার লোকেরা চলে গেল। রাত নামল। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ল। জামা না থাকায় খালি গায়ে কাঁপতে কাঁপতে সুখী লোকটা নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে শেষমেশ মারা গেল।
এই সুখী লোকের সুখের সঙ্গে পাগলের সুখের মিল আছে। তাদের দুজনেরই সুখের উৎপত্তিস্থল হলো অজ্ঞানতা। ঘরে আগুন লাগলে অবুঝ শিশু খিলখিলিয়ে সুখের হাসি হাসে। তার সুখও অজ্ঞানতাজাত। এই সুখ সর্বনাশা। এই সুখ বোধহীন। এই সুখ প্রগতিঘাতী।
এই সব আমাদের বিবেচনায় আছে। তাই তুচ্ছ সুখে আমাদের পোষায় না। দুর্যোধনের মতো আমরাও মনে করি ‘ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা’।
আমরা মনে করি, অসুখী ও লোভীরাই উন্নয়নের মূল কারিগর। মাটিতে হেঁটে সুখী হতে পারেনি বলেই মানুষ প্লেন বানাতে পেরেছে।
লঞ্চ আর ফেরি পারাপার নিয়ে সুখী হতে পারিনি বলেই আমাদের মনে সেতু বানানোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা পয়দা হয়েছে। আমরা মনে করি সেই ‘অ-সুখ’ই পদ্মা সেতুর আসল ভিত্তি।
ফলে গতবারের মতো এ বছরও সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার খবর আমাদের মোটেও বিচলিত করছে না।
গত বুধবার জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৪’ নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ১৪৩টি দেশের মধ্যে সুখী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯ তম অবস্থানে। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১৮।
সে হিসাবে এ বছর আমরা ১১ ধাপ পিছিয়েছি। গতবারের আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে আমরা ছিলাম ৯৪ নম্বরে।
আর টানা সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে নাম উঠে এসেছে ফিনল্যান্ডের। আর তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে আফগানিস্তান।
সুখী দেশের এই তালিকা যাঁরা করেছেন, তাঁরা ব্যক্তি ধরে ধরে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতি কী তা বিবেচনায় নিয়েছেন।
প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা, জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নিয়েছেন। এসবের ওপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করেছেন।
কিন্তু কথা হলো, এর মধ্যে জিডিপি বাদে যতগুলো বিষয় আছে, তার সবগুলোই একেক লোকের কাছে একেক রকম ঠেকতে পারে। ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা—এর কোনোটিরই তো কোনো স্পষ্ট অবয়ব নেই।
এগুলো পাঁচতলায় থাকা লোকের কাছে এক রকম ঠেকে, গাছতলায় লোকের কাছে ঠেকে আরেক রকম।
এই সব বিবেচনায় নিয়ে তালিকাওলারা আমাদের ফি বছর ফেল করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন না, এই সব তথাকথিত গবেষণালব্ধ সুখ ক্ষুদ্রের অবান্তর আত্মতুষ্টির প্রকাশ।
আর অন্যদিকে ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম। আমরা, মানে বাংলাদেশিরা বৃহতের ধর্মের অনুসারী।
এই তালিকা দেখে ভায়রার চেয়ে কম কামাই করে বিমর্ষ হয়ে পড়া লোকের মতো কিছু লোকের মনে হতে পারে, বাংলাদেশ আসলেই বুঝি চরম অ-সুখে বিষাদগ্রস্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিষাদ আর অ-সুখ এক জিনিস না। অনেকে আছে যারা সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে যা চায়, তা পায়। কিন্তু সে আরও চায়। এই লোক বিষণ্ন না। সতত অতৃপ্তিতে সে সারাক্ষণ অস্থির। সে সব সময়ই প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ধাপে ওঠার জন্য উদ্দীপ্ত। সতেজ।
আমরা মনে করি, নিজের ভায়রার চেয়ে যার মায়না পাঁচ শ টাকা বেশি, জগতে সে-ই সুখী। এই ইয়ার্কিময় হালকা কথার তলে থাকা ওজনদার কথাটি হলো, আমরা সুখী কি না, তা বোঝার তুলাদণ্ড হলো তুলনা।
কার সঙ্গে কার তুলনা? ঠাঁটারীবাজারের মিলন বখশের সঙ্গে ইলন মাস্কের তুলনা চলে না। তুলনা হয় আশপাশের লোক অথবা নিজেরই অতীতের সঙ্গে। সেই তুলনাটিই কে কত সুখী, তা মাপার আসল পাল্লা-পোড়েন।
এক পাল্লায় নিজেকে, আরেক পাল্লায় আর কাউকে রাখলে সুখের ‘পরিমাণ’ বোঝা যায়। কার তুলনায় কে বেশি সুখী বা কম সুখী, তা তখন ধরা পড়ে।
ইউরোপ আমেরিকার জল হাওয়া, সেখানকার মানুষের মেজাজ মর্জি আর তাদের জিডিপি, পার ক্যাপিটা ইনকাম, রিজার্ভকে প্যারামিটার ধরে তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করে এগোলে আমরা মানব কেন?
আমরা মনে করি, সুখের অব্যয় সংজ্ঞা ঠিক করা অসম্ভব। এই কারণে জাতিসংঘের এই তালিকা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানো ঠিক হবে না।
এই তালিকা দেখে ভায়রার চেয়ে কম কামাই করে বিমর্ষ হয়ে পড়া লোকের মতো কিছু লোকের মনে হতে পারে, বাংলাদেশ আসলেই বুঝি চরম অ-সুখে বিষাদগ্রস্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিষাদ আর অ-সুখ এক জিনিস না।
অনেকে আছে যারা সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সে যা চায়, তা পায়। কিন্তু সে আরও চায়। এই লোক বিষণ্ন না। সতত অতৃপ্তিতে সে সারাক্ষণ অস্থির। সে সব সময়ই প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ধাপে ওঠার জন্য উদ্দীপ্ত। সতেজ।
বিষাদের সঙ্গে নিস্তেজ আত্মমায়া থাকে। অতৃপ্ত ও অসুখী মানুষ সে আত্মমায়াকে পাত্তা দেয় না। সে সুখ চায় না। জয় চায়। জাতিসংঘের সূচক ধরে তাকে অসুখী বলা যেতে পারে। কিন্তু সেই বলাটা সে কতটা মেনে নেবে, তা তর্কসাপেক্ষ।
দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে জাতিসংঘের সংজ্ঞায় পড়ে যাওয়া অ-সুখ ধরা পড়ছে। কিন্তু এই অ-সুখই যে সেই প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোকটির মতো দেশ ও দেশের মানুষকে পরবর্তী প্রতিষ্ঠার ধাপে পা বাড়ানোর জন্য প্রাণবন্ত করে রাখে, সেটি কি জাতিসংঘ তার গবেষণায় বলেছে?
জামাহীন সুখী লোকের সুখ আর ঘরে আগুন দিয়ে খিলখিলিয়ে সুখের হাসি হাসা শিশুর বোধহীন সর্বনাশা প্রগতিঘাতী সুখের চেয়ে সচেতনতা-জাত অ-সুখ কি ভালো নয়?
‘অসুখী’ বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর তুলনায় ফি বছর আরও বেশি অসুখী হচ্ছে—এর মানে কি আমরা আরও বেশি অতৃপ্ত-উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আরও বেশি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছি না!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]