বাবারে! কী জিনিয়াস! কী মেধাবী! কী এলেমদার! কী কামেল মানুষ! হোয়াট আ ম্যান অব অ্যাকশন! যাঁকে ঘিরে দুই দিন ধরে এই সব এক্সক্লামেটরি চিহ্নসূচক ভাবনা মাথার চাঁন্দির চাড়ায় বাড়ি খাচ্ছে, তাঁর দেশের বাড়ি কোটালীপাড়ায়, ‘বিদেশের বাড়ি’ দুবাইতে। তাঁর ব্যাপারে যতই খবর পাচ্ছি, ততই তাঁর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে; ততই তাঁকে ‘বুকে আয় ভাই’ বলে জড়ায়ে ধরতে মন আছাড়িপিছাড়ি করছে।
মরু আরবের শেখদের বালুতে ফোটা এই বিরল প্রজাতির বাঙালি ক্যাকটাসের নাম আরাভ খান (‘বড়লোকি’ উচ্চারণে ‘আরব’ হয়ে গেছে ‘আরাভ’)। তিনি দুবাইয়ে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটা গয়নার দোকান দিয়েছেন। ৪৫ কোটি টাকা খরচা করে মাত্র ৬০ কেজির সোনায় বানানো বাজপাখি দোকানের কোনায় লোগো হিসেবে বসানো হয়েছে। বুধবার সেই দোকানের ঝাপ খোলা অনুষ্ঠানে ইউটিউব সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে নাট্য ও চিত্রজগতের উদীয়মান, উদিত ও অস্তমান তারকারা, এমনকি একজন বিশ্বসেরা ক্রিকেটাররাও হাজির ছিলেন।
দুবাইয়ে রওনা হওয়ার আগে প্রায় সবাই ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় কিংবা লাইভে এসে দোকান নম্বর উল্লেখ করেটরে ‘আমি থাকছি আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, আপনি থাকছেন তো!’ বলে বেশ কলকাকলী করেছেন।
কিন্তু ঝাপ খোলা অনুষ্ঠানের আগেই আরাভ খানের মান সম্মান খান খান করে দিয়ে পুলিশ আর সাংবাদিকেরা জানান, আরাভ আদতে খান বংশের লোক নন। তিনি মোল্লা বংশের লোক। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের মতিউর রহমান মোল্লা তাঁর আব্বা এবং লাকি বেগম তাঁর আম্মা। এক সময় ভাঙা শিশি-বোতল, প্লাস্টিকের ছেঁড়া স্যান্ডেল ইত্যাদির বদলে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল গ্রামে গ্রামে ফেরি করে অতিকষ্টে সংসার চালানো মতিউর মোল্লা অতি আদর-সোহাগে ছেলের নাম রেখেছিলেন, ‘সোহাগ মোল্লা’। সেই ছেলে সোহাগ মোল্লা ঢাকায় এসে হয়ে যান রবিউল ইসলাম। এখন পুলিশের খাতায় তাঁর নাম রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিক।
চার বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়েছিলেন রবিউল। সেই মামলায় রবিউল ইসলাম নামের এক লোক আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। সেই লোক ৯ মাস জেল খাটার পর বললেন, ‘আমি রবিউল না, আমার নাম আবু ইউসুফ।’ তিনি জানালেন, রবিউল তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে টাকা দেবেন—এই শর্তে তিনি রবিউলের হয়ে প্রক্সি দিয়ে যাচ্ছেন। রবিউল টাকা দেওয়া বন্ধ করায় তাঁর পক্ষে আর রবিউলের ‘পাট করা’ সম্ভব হচ্ছে না। পরে পুলিশ জানল, আসল রবিউল ভারতে গিয়ে ভুয়া নাম-পরিচয়ে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেছেন। পাসপোর্ট নাম দিয়েছেন আপন আরাভ খান। সেই নামেই দুবাইয়ে পাড়ি দিয়েছেন।
এরপর মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদি ওরফে আরাভ খান (চলবে...?) যা দেখালেন তা সবাই এর মধ্যে জেনে গেছেন। তিনি নিজেও ফেসবুকে তিনবেলা আপডেট জানাচ্ছেন। তিনি ফেসবুকে ভিডিও করে দেখিয়েছেন, বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। আরও আছে সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি। দামি গাড়ির কথা তো বাদই থাকল।
এখন আমরা পুলিশের কাছ থেকে জানতে পারছি, ইন্টারপোলের সহায়তায় এই উদ্যোক্তাকে দেশে আনার একটা চেষ্টা চলছে। পুলিশ বলছে, যাঁরা দাওয়াত পেয়ে (দাওয়াতের বাইরে রাহাখরচ বা অন্য কিছুর খরচ পেয়েছেন কিনা তা অবশ্য আমরা জানি না, এ বিষয়ে আমরা বড়জোর আন্দাজ করতে পারি) দোকান উদ্বোধনে যাচ্ছিলেন, তাঁদের আগেই আরাভ খানের বিষয়ে জানানো হয়েছিল এবং সেখানে যেতে মানা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সে মানা না শুনে ছুটে গিয়েছেন। সম্ভবত ‘প্রেমের টানে’র কারণে তাঁদের ধরে রাখা যায়নি।
এখন সবাই যে কথাটি ভেবে মাথার চুল ছিঁড়ছে, সেটি হলো মাত্র তিন বছরের মধ্যে খুনের মামলার একজন ফেরারি আসামির হাতে এত টাকা এল কোত্থেকে? আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের পক্ষেও তো এত শর্ট টাইমে এত টাকা সাপ্লাই দেওয়া কঠিন। কেউ কেউ আন্দাজ করে বলছে, এই সয়-সম্পত্তির মালিক আসলে দেশের কোটি কোটি টাকা পাচার করা অন্য কেউ। সোহাগ মোল্লাকে আরাভ খান বানিয়ে সেই ‘অন্য কেউ’ আড়ালে থাকছেন।
গ্রিক পূরানের ফিনিক্সের মতো পারস্য উপকথায় হুমা পাখি বলে একটি পাখির কথা আছে। ফারসি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তারের ‘মানতিক–উত– তায়ের’ (‘পাখি সম্মেলন’) মহাকাব্যে এই পাখির উল্লেখ আছে। কথিত আছে, হুমা পাখি কখনো মাটিতে নামে না। সে থাকে মেঘের ওপরে। কেউ তাঁকে দেখতে পায় না। তবে কারও মাথায় যদি কোনো দিন হুমা পাখির ছায়া পড়ে, তাহলে সে নির্ঘাৎ বাদশাহ হয়ে যায়।
এই প্রবল রহস্যময় ফেরারি আসামির মেহমান হয়ে আইডল কিসিমের লোকজন তাঁর প্রতিষ্ঠানে, অফিসে, বাসায় যাচ্ছেন; খাচ্ছেন-দাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে হেসে ছবি তুলে ধন্য হচ্ছেন। পুলিশ তাঁকে দেশে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি তাতে পাত্তাই দিচ্ছেন না। কী একটা সার্কাসমতো ব্যাপার!
গ্রিক পূরানের ফিনিক্সের মতো পারস্য উপকথায় হুমা পাখি বলে একটি পাখির কথা আছে। ফারসি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তারের ‘মানতিক–উত– তায়ের’ (‘পাখি সম্মেলন’) মহাকাব্যে এই পাখির উল্লেখ আছে। কথিত আছে, হুমা পাখি কখনো মাটিতে নামে না। সে থাকে মেঘের ওপরে। কেউ তাঁকে দেখতে পায় না। তবে কারও মাথায় যদি কোনো দিন হুমা পাখির ছায়া পড়ে, তাহলে সে নির্ঘাৎ বাদশাহ হয়ে যায়।
আরাভ জুয়েলার্সের ৬০ কেজি সোনার বাজপাখি দেখছি আর ভাবছি, আমার দেশিভাই সোহাগ মোল্লার মাথায় ছায়া ফেলা হুমা পাখিটা কে?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]