রাশিয়া বিশ্বের মন জয় করতে যে কৌশল নিয়েছে

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে রাশিয়ার কূটনীতিকেরা অসংখ্যবার সফর করেছেন। ২০২৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত রাশিয়ার কর্মকর্তারা আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা, বুরুন্ডি, ইরিত্রিয়া, এসওয়াতিনি, কেনিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সুদান সফর করেছেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও কিউবা সফর করেছেন। দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে সমর্থন আদায় করার উদ্দেশ্য থেকেই মস্কোর এই কূটনৈতিক উদ্যোগ। 

ইউক্রেনে পশ্চিমা শক্তি ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে রাশিয়া—এই দাবি করে গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের মন জয় করতে চেষ্টা করছে রাশিয়া। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং ডিজিটাল মাধ্যমে অপতথ্য ছড়িয়ে ‘বিশ্বমঞ্চে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন’ ঘটছে। ২০১০–এর দশকে আফ্রিকা মহাদেশে রাশিয়া যে প্রভাব তৈরি করতে পেরেছিল, তার কারণ ছিল ‘অর্থনৈতিক সুযোগকে’ কাজে লাগিয়েছিল তারা । কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর মস্কো কৌশলগত উদ্দেশ্য থেকেই নিজেদের প্রভাব বিস্তারের কাজটি করছে।

আরও পড়ুন

যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে সম্প্রতি রাশিয়া নিজেদের প্রভাব আরও গভীর করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেখে মনে হচ্ছে দেশটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সরে আসছে এবং চীন ও রাশিয়া অক্ষের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়টা আংশিক সত্য। কেননা গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে বর্তমান উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার ওপর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারলে তাতে তারা লাভবান হবে। বৈশ্বিক দক্ষিণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে আরও সক্ষম হয়ে উঠবে।

সদ্য সমাপ্ত ব্রিকস সম্মেলনে এর প্রতিফলন দেখা গেল। রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা এই সম্মেলনে সমবেত হয়েছিলেন। বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর এই জোটের নেতারা ইউক্রেন যুদ্ধের পুরো দায় রাশিয়ার একার ঘাড়ে চাপাতে রাজি হননি। সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সীমাবদ্ধতাকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ব্রিকস জোটের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে লুলা বলেন, বিশ্বে ব্রিকস এখন প্রাসঙ্গিকতার প্রতীক। নতুন ছয়টি দেশকে ব্রিকস সদস্য করায় এই প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিতভাবেই আরও বাড়বে। 

বৈশ্বিক দক্ষিণ কেন রাশিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং কেন তারা ইউক্রেনকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছে না—এ দুটি প্রশ্নে পরস্পর–সম্পর্কিত একটি উত্তর আছে। বৈশ্বিক দক্ষিণে, বিশেষ করে আফ্রিকায় রাশিয়া নিজেদেরকে ‘উপনিবেশবাদবিরোধী’ সংগ্রামের সংস্থা হিসেবে হাজির করছে। মস্কোর এই কৌশলকে ‘স্মৃতি কূটনীতি’ বলা যায়। বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে ইতিহাস সেটিকেই পুঁজি করছে রাশিয়া।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লিগের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো। এই সংগঠনে বিশ্বের উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনকর্মীরা একত্র হয়েছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইন ও মহাত্মা গান্ধীর মতো বিশিষ্টজনেরাও সেখানে ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লিগ বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক নেতার কাছে তাদের দেশকে উপনিবেশ থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেল। এই পরম্পরা থেকেই এই দেশগুলো মস্কোর প্রতি নমনীয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন—সেই ইতিহাসকে এখন সামনে আনছে রাশিয়া। মস্কো এটাও বলছে যে আফ্রিকার কোনো দেশে তারা কখনো উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেনি এবং সেখানে কোনো দাস ব্যবসার সঙ্গেও তারা জড়িত ছিল না। এ ছাড়া শীতল যুদ্ধ চলাকালে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল রাশিয়া। দৃষ্টান্ত হিসেবে অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের কথা বলা যায়।

আরও পড়ুন

আফ্রিকার উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামে মস্কোর সংহতি জানানোর পরম্পরা অনেক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯২৭ সালে যখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লিগ গড়ে উঠেছিল, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (সাম্যবাদীদের বৈশ্বিক সংগঠন) তাতে সমর্থন দিয়েছিল।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লিগের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো। এই সংগঠনে বিশ্বের উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনকর্মীরা একত্র হয়েছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইন ও মহাত্মা গান্ধীর মতো বিশিষ্টজনেরাও সেখানে ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লিগ বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক নেতার কাছে তাদের দেশকে উপনিবেশ থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেল। এই পরম্পরা থেকেই এই দেশগুলো মস্কোর প্রতি নমনীয়।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেক অনূদিত

হোসে ক্যাবিয়ারো ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ