বর্তমানে আমরা একটি তথ্যনির্ভর বিশ্বে বসবাস করি, যেখানে তথ্য সর্বত্র ও তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হয়। এ বিশ্বে তথ্যই শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তিতে নির্ভরশীল বর্তমান বিশ্ব ডিজইনফরমেশন (অপতথ্য) এবং মিসইনফরমেশনের (ভুল তথ্য) ভয়াবহ আঘাতে জর্জরিত। অপতথ্য ও ভুল তথ্য মারাত্মক সমস্যা ও হুমকি হিসেবে হাজির হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
স্বচ্ছতা, নীতিমালার নির্ভুলতা এবং সত্যতা যাচাইয়ের অনুশীলনের অভাবের কারণে অনেক বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া খবরের দৌরাত্ম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয় বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভিত্তি নির্মাণে ভয়াবহ হুমকির কারণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তা এবং জনসাধারণের কাছে এর অব্যাহত গ্রহণযোগ্যতা অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অপতথ্য ও ভুল তথ্য শব্দ দুটো বিভিন্ন সময় একই অর্থে ব্যাখ্যা করা হলেও দুটো শব্দের মধ্যে রয়েছে অর্থগত ব্যাপক পার্থক্য। অপতথ্য মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। অপতথ্য বলতে একটি সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও সংগঠিত গোষ্ঠী কর্তৃক প্ররোচিত মিথ্যা তথ্যকে বোঝানো হয়। যেমন একটি দেশের সামরিক শক্তি বা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারিত বিভ্রান্তিকর বা পক্ষপাতমূলক তথ্যই অপতথ্য।
অন্যদিকে ভুল তথ্য হলো এমন একপ্রকার তথ্য, যা ভুল কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি তৈরির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয় না। এর পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকে না। ভুল তথ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন আকারে ছড়ালেও অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি জড়িত থাকে, যার ফলে অপতথ্য প্রতিহত করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভুয়া সংবাদের প্রচার, মিথ্যা বর্ণনাকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়ার জন্য কাল্পনিক ব্যক্তি বা সংস্থা তৈরি করার মাধ্যমে অপতথ্য প্রচার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
আস্থার ক্ষয়, নির্বাচনের কারসাজি ও সামাজিক বিভাজনের তীব্রতা রয়েছে, এমন সমাজে অপতথ্যের পরিণতি হতে পারে সুদূরপ্রসারী। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে ব্যবহার করে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য অপতথ্যের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করেছিল। পরে পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, ভোটারদের মধ্যে অপতথ্য ছড়িয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছিল, তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
অপতথ্য ও ভুল তথ্য সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সামাজিক সংহতিকে নষ্ট করে, সহযোগিতাকে ব্যাহত করে এবং অগ্রগতিতে বাধা দেয়। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট করে। ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য জনমতকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করতে পারে। বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা রাজনৈতিক মেরুকরণে ইন্ধন জোগাতে পারে, সামাজিক বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদের বিস্তার জনসাধারণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে, যা তাদের সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অপতথ্য ও ভুল তথ্যের ব্যবহার এবং প্রচারণার কৌশল হিসেবে এই দুই পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ ধরনের অসত্য ও ভুল তথ্য প্রচার করা হয়ে থাকে।
অপতথ্য ও ভুল তথ্য সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ ধরনের তথ্য যখন ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন এটি বৈষম্যমূলক মনোভাবকে প্রসারিত করতে পারে। কিছু সম্প্রদায় সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচার তাদের আরও প্রান্তিক করতে পারে এবং সামাজিক সংহতি নষ্ট করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক হামলার কিছু নজির উল্লেখ করা যায়।
যেগুলো ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ভুয়া খবরের মাধ্যমে। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে উত্তম বড়ুয়া নামের বৌদ্ধ তরুণের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করার খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই ফেসবুক পোস্ট রামুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্ম দেয়। মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অপতথ্য ও ভুল তথ্যের ব্যবহার এবং প্রচারণার কৌশল হিসেবে এই দুই পদ্ধতিকে কাজে লাগানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ ধরনের অসত্য ও ভুল তথ্য প্রচার করা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পাশাপাশি দেশে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রচারের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। এ ধরনের তথ্য ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বীজ বপন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে। এর ফলে নির্বাচনের বৈধতাও নষ্ট হতে পারে।
প্রচারণায় অপতথ্য ব্যবহারের কৌশল নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দিতে পারে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যে এ ধরনের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যেমন করে ওয়াশিংটনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরকে কেন্দ্র করে নানামুখী তৎপরতা এবং অপতথ্যের প্রচার পরিলক্ষিত হয়েছে। সফরের আগে ভারতীয় গণমাধ্যমকে উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে যে মোদি-বাইডেনের এই সংলাপে বাংলাদেশের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হবে। কিন্তু এই সফর ও বিষয়সূচির ওপর ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের ব্রিফিং এবং পরে প্রকাশিত মোদি-বাইডেনের যৌথ বিবৃতি পর্যালোচনা করে এ ধরনের কোনো আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা খুবই দুর্বল। ফ্যাক্ট চেক ও অন্য প্রচলনগুলো এখনো সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া অপতথ্য প্রতিহত করার পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষ এখনো যথেষ্ট অবগত নন। অপতথ্য ও ভুল তথ্যকে মোকাবিলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে সংবাদমাধ্যমের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার প্রসার, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করা, স্বাধীন গবেষণাকে সমর্থন করা, জনসচেতনতা প্রচার, নিয়ন্ত্রক কাঠামো আরও গতিশীল ও জনমুখী করা এবং অংশীদারত্ব গড়ে তোলা।
দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তথ্যের প্রচার, যেমন উৎস যাচাই করা এবং অযাচাইকৃত তথ্যের বিস্তার এড়ানো, ভুল তথ্যের বিস্তার রোধে সাহায্য করতে পারে। প্রচারের আগে তথ্য যাচাই করার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া মিথ্যা তথ্যের বিস্তার রোধে সাহায্য করতে পারে। বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার লক্ষ্যে এ ধরনের ভুল তথ্য ও গুজবের প্রচার রোধ করা একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এই বিষয়টি বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিষয়টি যত শিগগির সম্ভব আমাদের গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করতে হবে।
বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ অপতথ্য প্রতিহত করার বিষয়ে সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গেছে যে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে এই বিষয়ে সক্ষমতা খুবই দুর্বল।
এ ক্ষেত্রে অনেক কাজ করার অবকাশ রয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম একটি ডিজিটাল ব্যক্তিসত্তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপতথ্যকে কাজে লাগানো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রমের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিভিন্ন কর্মশালাগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও সাইবার সুরক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি বাংলাদেশকে নিতে হবে। বাংলাদেশকে একটি ন্যায্য, সুশৃঙ্খল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিপূর্ণ ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ