নাম তাঁর অরুণ, অরুণ কর্মকার। পদবিই বলে দিচ্ছে তিনি পেশায় কামার। ‘আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের....নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে, নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে’—কালজয়ী এ গানের কথা কতটা এ ‘কালে’ ফলেছে, তার মামুলি একটা উদাহরণ হতে পারেন অরুণ।
৫২ বছর ধরে লোহার পিণ্ড পিটিয়ে নানা আকৃতির প্রয়োজনীয় সব জিনিস দা, বঁটি, কাস্তে, ছুরি ইত্যাদি তৈরি করছেন, কিন্তু তাঁর জীবনের ‘আকৃতি’ যে–কে সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে! অরুণের কর্মজীবনের বয়স আর স্বাধীন দেশে সূর্য ওঠার বয়স প্রায় সমান। অরুণ মানেও সূর্য, কিন্তু তাঁর জীবনে আলো নেই, যে আলোর সমনাম স্বচ্ছন্দ, উন্নতি, মানবিক মর্যাদা...। তাই অরুণ নামটা যেন তাই প্রহসনের সমার্থক হয়ে ওঠে! সেই অর্থে আরেক মাত্রা যোগ করে অরুণের কামারশালা, যেখানে বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থাটুকুও নেই। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গেছে, কিন্তু তরুণ তাঁর কর্মস্থলে একটা বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালানোর সামর্থ্য অর্জন করতে পারেননি! তাঁর দোকানটি চলে সূর্যের নিয়মে; আলো ফুটলে দোকানের ঝাঁপ তোলা হয়, আলো ফুরিয়ে গেলে কাজকর্ম গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। এভাবেই আজীবন উদয়-অস্ত খেটে চলেছেন তিনি। ফল, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হ্যান্ড টু মাউথ’।
অরুণ কর্মকারের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার জামতৈলে। গ্রামটির প্রায় মাঝবরাবর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন—ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা।
জামতৈল স্টেশনের পুব পাশে রাস্তার ধারেই অরুণের কামারশালা। রেললাইনের পশ্চিমে গ্রামের একটু ভেতরে বাড়ি। প্রতিদিন সকালে কিছু মুখে দিয়েই দোকানে চলে আসেন তিনি। একটু বেলা বাড়লে দুপুরের ভাত দিয়ে যান ভাতিজা। না, অরুণের কোনো ছেলেসন্তান নেই। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ভাই মারা যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব পড়েছে অরুণের ওপর। তাঁর ভাষায়, পরিবারে এখন চার সদস্য। বড় ভাইয়ের ছেলেটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করছেন। এরপর তিনি চাকরিবাকরি পেলে হয়তো দিন বদলাবে! কিন্তু চারদিকে এত বদলের গল্প গুঞ্জরিত, গরম লোহা পেটানোর কোনো ফাঁকে তার ছিটেফোঁটাও যায় না অরুণের কানে? উত্তরে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘কে কাকে ঠকায়্যা কে আগায় যাইব, সেই প্রতিযোগিতা চইলত্যাছে।’
অরুণের পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কৈশোরে বাবা মনোরঞ্জন কর্মকারের কাছেই বাপ-দাদার পেশায় হাতেখড়ি। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে অরুণের। তখন বয়স ১০-১২ বছর ছিল বলে তাঁর অনুমান। তিনি ও তাঁর বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ‘স্পাই’ হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানালেন। তবে এ জন্য কখনো সরকারি কোনো আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেননি।
আয়রোজগারের প্রসঙ্গ তোলায় একটু যেন চুপসে গেলেন অরুণ। কাজ করতে করতেই এক হাত ওপরে দিকে তুলে বললেন, ‘মালিক চালায়া ন্যান।’ কোনো দিন ১০০ টাকাও হয়, আবার কোনো দিন ৪০০-৫০০ টাকাও হয়। ধান কাটার মৌসুমে নতুন কাঁচি তৈরিসহ পুরোনোগুলো ধার দেওয়ার কাজ বাড়ে, সে সময় আয়টা বেশ ভালো হয়। আবার ঈদুল আজহার আগে ছুরির অনেক কাজ থাকে, তখনো রোজগার বাড়ে। বছরের বাকিটা চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
জিনিসপত্রের এত দাম! দিন দিন প্রায় সবকিছুরই তো দাম বাড়ছে। কীভাবে সামাল দেন? আগের মতোই কাজ করতে করতে এক হাত ওপর তুলে ‘মালিক চালায়া ন্যান’, পুনরুক্তি করলেন অরুণ। একটু থেমে বললেন, ‘বাবা কয়া গেছেন, “সৎপথে থাইকব্যা, খাওয়া-পরায় ঠেইকব্যা না।”’ বাবার এই কথা অক্ষরে অক্ষরে মানেন।
অরুণ যখন তাঁর বাবার উপদেশের কথা বলছিলেন, তখনই পাশের রেললাইন ধরে শাঁ শাঁ করে চলে গেল রাজশাহীমুখী একটি এক্সপ্রেস ট্রেন, যেটি জামতৈল স্টেশনে থামে না। ট্রেন চলার সময় যেমন বেশ শব্দ হয়, তেমনি আশপাশের স্থাপনাতেও তার বেশ কম্পন অনুভূত হয়। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া, বাঁশের খুঁটির ওপর পুরোনো ঝরঝরে টিনের দোচালা—অরুণের কামারশালাটি এতটাই কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি ভেঙে পড়বে! তবে পড়তে পড়তেও পড়ল না, অরুণের ‘মালিক’ বুঝি সেটি ‘ঠ্যাকায়া’ রাখলেন!
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক
[email protected]