সিলেটের হাবুডুবু দশা নিয়ে তামাশা বন্ধ হোক

জলমগ্ন সিলেট শহর। নগরের মৌবন আবাসিক এলাকাছবি: প্রথম আলো

গত তিন সপ্তাহে সিলেট–সুনামগঞ্জ ডুবেছে কম করে হলেও পাঁচবার। সেখানকার মানুষ একবার ঘরে ফিরছে, আবার ঘর ছাড়ছে। মূলত ঘূর্ণিঝড় রিমাল আছড়ে পড়ার পর অবস্থা বেশি সঙিন হয়ে ওঠে। তিন জোয়ারি আর ধীরগতির রিমাল যে আসামের মেঘালয়ে গিয়ে আরও বৃষ্টি ঝরাবে আর সিলেট তলাবে, তা স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল।

আমাদের আবহাওয়ার ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’–জাতীয় বার্তাগুলোয় সে সতর্কতার কথা ছিল না। উপকূলের ঝড় উপকূলে যে শেষ হয় না, সেটা রোল মডেলের দেশ বাংলাদেশে কেন কারও মাথায় আসে না, সেটাই হলোই বিস্ময়! বানের এই আগাম তথ্যটা পেলে মানুষ অন্তত মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারত। ডিজিটালের যুগে কমপক্ষে চার্জার আর গ্যাস সিলিন্ডারের একটা ব্যবস্থা করে রাখতে পারত।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাগুজে কমিটিগুলো অন্তত বলতে পারত না, ‘আমরা জানতাম না তাই আশ্রয়কেন্দ্রের কোনো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না।’

আগাম খবর পেলে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বন্যাকবলিত নিরুপায় মানুষদের ফাঁকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হতো না। কিন্তু সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পানি, বিদ্যুৎ, বাথরুমের লাইন বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অসহায় বন্যার্তরা পরে একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কিন্তু আমাদের স্ট্যান্ডিং অর্ডার অনুযায়ী উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য।

উপজেলার এই কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলির মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে: ১. উপজেলা পর্যায়ে স্থানান্তর, সন্ধান, উদ্ধার ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য জরুরি পরিচালনা কেন্দ্র বা নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা। ২. আগের তালিকা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য সুবিধা ব্যবহার করে জরুরি উদ্ধার কার্যপরিচালনা। ৩. দুর্যোগকালে নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ (সূত্র: দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি ২০১৯)

যেখানে উপজেলার এই কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি আশ্রয়প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেবেন, সেখানে পানি, বিদ্যুৎ, বাথরুমের লাইন বন্ধ করে তাদের একটা নিরাপদ জায়গা থেকে একপ্রকার তাড়িয়ে দিলেন। সংবাদকর্মীরা পরিস্থিতি এবং ঘটনার বিষয়ে জানতে গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে (তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি)। তিনি কথিত বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। সিলেট ডেপুটি সিভিল সার্জন বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো কিছু জানা নেই।’

একটা জনবান্ধব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য এখনো আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। শুধু আইন আর কমিটি দিয়ে হবে না

বিষয়টি নিয়ে এখন বাদ-প্রতিবাদ চলছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি বিষয়টি সুরাহা করার জন্য একটা সভা ডাকতে পারত। সে পথে এখনো কেউ হাঁটেনি।

গত ১৮ জুন থেকে ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলে কুশিয়ারা ও নলজোর নদ-নদীর পানি বেড়ে যায়। এতে জগন্নাথপুর উপজেলার একটি পৌরসভার ও আটটি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাটবাজারসহ দুই শতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। ছোট–বড় সব সড়কই তলিয়ে যায়। এ অবস্থায় উপজেলার ৮৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৬ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন। গত শনিবার ২২ জুন থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করলে বানভাসিদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।

তবে ধীরগতিতে পানি কমায় এখনো নিম্নাঞ্চল প্লাবিত রয়েছে। তাই অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলের মানুষেরা অন্যদের মতো ঘরে ফিরতে পারেননি। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী থেকেও তাঁরা বঞ্চিত।

চার দিন আগপর্যন্ত টানা ৯ দিন ধরে ৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ আটকে ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় আশ্রিত হয় আরও শতাধিক পরিবার। আশ্রয়কেন্দ্রে সাহায্য হিসেবে দুর্গতরা পেয়েছেন চিড়া–মুড়ি আর সামান্য চাল। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণসামগ্রী বিতরণেও শিথিলতা এসেছে। বন্যার পানিতে অনেকের ঘর ভেঙে যাওয়ায় ভিটায় ফিরে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকা সম্পূর্ণ হলে জেলায় পাঠানো হবে।

এই যখন মাঠের অবস্থা, তখন প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মূল আলোচনা সিলেটের বন্যার জন্য কে দায়ী? বাঁধ, না হাওরের রাস্তা দায়ী। রাস্তা দায়ী হলে হাওরে পানি কম কিন্তু সিলেট ডোবে কেন? কাউকে এককভাবে দায়ী না করে বলা যায় ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনার প্যাঁচে আমরা খাবি খাচ্ছি।

বছর দুয়েক আগে সিলেটের তৎকালীন মেয়র সিলেটের পানি আটকানো বন্যার যে কারণগুলো বাতলেছিলেন, সেগুলো এখনো সত্য। মেয়রের ভাষ্য অনুযায়ী বন্যার অন্যতম কারণ নগরবাসীর যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, ঢলে টিলা ধসে ছড়া ও ড্রেন ভরাট এবং সময়মতো ড্রেন-ছড়া পরিষ্কার না করা। সে সময় তিনি বলেছিলেন নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, পথচারীরা বা ব্যবসায়ীরা লেপ–তোশক থেকে শুরু করে পলিথিনসহ সবকিছুই রাস্তায় ফেলেন, সব গিয়ে ড্রেনের ছিদ্রগুলো ব্লক করে দেয়। একদিকে বেশি বৃষ্টি, অন্যদিকে ব্লকের কারণে পানি ড্রেন দিয়ে নামতে পারে না। জলাবদ্ধতা হওয়ার এটা অন্যতম কারণ।

সেদিন তিনি বলেছিলেন রাত বা দিন, যেকোনো সময় অতিবৃষ্টি হলেই আটটি স্ট্রাইকিং টিম পরিচ্ছন্নতাকাজের জন্য প্রস্তুত থাকবে। ইতিমধ্যে নগরপিতা পরিবর্তন হয়েছে। বিলেতি অভিজ্ঞতার নতুন নগরপিতাকে বন্যামুক্ত সিলেট গড়ার কাজে হাত দিতে হবে।

ওপরের বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কার যে একটা জনবান্ধব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য এখনো আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। শুধু আইন আর কমিটি দিয়ে হবে না।

● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]