বিশেষ সাক্ষাৎকার: মো. জিল্লুর রহমান
সিডর, আইলার চেয়ে মোখায় ঝুঁকি বেশি
মো. জিল্লুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান এবং আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূপ্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিদ্যার ওপরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ-জিএসবিতে প্রকৌশল ভূতত্ত্ব বিষয়ে কাজ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে তঁার ৬৫টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ
প্রশ্ন :
ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলাসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে আঘাত হানতে পারে। এর সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে বলে মনে করেন?
মো. জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের ওপরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে মোখা বেশ ব্যতিক্রম। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও ইয়াসের মতো শক্তিশালী ঝড়গুলো মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত করেছে। দেড় দশক ধরে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মানুষ ও স্থানীয় প্রশাসন তাই এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ কক্সবাজার জেলা এবং উপকূলীয় অন্যান্য দ্বীপগুলো এই ঝড়ের মুখে পড়তে যাচ্ছ। ফলে এখানে আমাদের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রশ্ন :
কেন বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন?
মো. জিল্লুর রহমান: প্রথমত কক্সবাজার এলাকাটির ভূপ্রকৃতি দেশের অন্য এলাকাগুলোর থেকে আলাদা। এখানকার বেশির ভাগ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত। আর দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার পাহাড়গুলো নরম শিলা বা মাটি দিয়ে গঠিত। সেখানে বালুর পরিমাণও বেশি। এ ধরনের পাহাড় বেশি ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। দ্রুত পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকে। তার ওপরে টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়গুলোতেই রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলো গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রায় ১২ লাখ মানুষ বসবাস করছে। ওই চাপে পাহাড়গুলো এমনিতেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যদি দেড় শ থেকে দুই শ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় আর ভারী বৃষ্টি হয়, তাহলে তো বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
দ্বিতীয়ত আমাদের সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বড় অংশে বেড়িবাঁধ নেই। আর ঘূর্ণিঝড়টি ওই দ্বীপগুলোর ওপর দিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এই দ্বীপগুলোর বড় অংশ ঝোড়ো বাতাসের কবলে পড়া ছাড়াও ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের শিকার হতে পারে। এত উঁচু জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্র সেখানে খুব বেশি নেই। আর বিশেষ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় অধিবাসী আছে। তারা মূলত কঁাচা ঘর ও ঝুপড়িতে থাকে। তাদের ওই দ্বীপে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেলগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই অবকাঠামোগুলো এত তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার জন্য উপযোগী কি না, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।
তৃতীয়ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও রাঙামাটিতে ঝড়ের সময় বাতাস খুব বেশি না গেলেও অন্য বিপদ আছে। ওই এলাকায় টানা ভারী বৃষ্টি হলেই পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকে। আর এসব এলাকা এত দুর্গম যে সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন।
প্রশ্ন :
তাহলে আমাদের ওই তিন ধরনের এলাকার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে?
মো. জিল্লুর রহমান: সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ক্ষেত্রে আমি বলব সেখানকার সব অধিবাসীকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, ঝড় শুরু হয়ে গেলে সেখানে থাকা বেশির ভাগ মানুষের জন্য বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। কোনো দ্বীপে অবকাঠামো গড়ে তোলার সময় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কথা মাথায় রেখে এর প্রকৌশল ও স্থাপত্যকাঠামো গড়ে তুলতে হয়। ভাসানচরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে। সেখানকার বাড়িগুলো ২৬০ কিলোমিটার ঝড় মোকাবিলায় সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া এর চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেন্ট মার্টিনের বেশির ভাগ স্থাপনা ও হোটেল-মোটেল কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেখানে স্থানীয় লোকজন যেখানে আশ্রয় নেবে, ঝড়ের সময় যে তা ভেঙে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এতগুলো মানুষকে এমন অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে রাখার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন :
সাগর তো এখন উত্তাল, ঝোড়ো বাতাসও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের উদ্ধার করা কি সম্ভব?
মো. জিল্লুর রহমান: আমাদের সরকারি-বেসরকারি অনেক জাহাজ আছে। নৌবাহিনীরও অনেকগুলো জাহাজ রয়েছে। সেগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে কক্সবাজারের কোনো নিরাপদ এলাকায় নিয়ে আসা উচিত। সোনাদিয়া দ্বীপেও অনেক মানুষ থাকে। সেখানেও বাঁধ নেই, তবে বন আছে। তবে যে পরিমাণে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে সেখানকার অধিবাসীদেরও সরানো উচিত। কুতুবদিয়া, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও সন্দ্বীপে অবশ্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় তাদেরও দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে হবে।
প্রশ্ন :
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর ঝুঁকির বিষয়টির তো কিছু আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত আছে।
মো. জিল্লুর রহমান: রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই আলাদা গুরুত্ব পাবে। কারণ, সেখানে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা কাজ করছে। এই জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্বেগও আছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর পাহাড়ে উপর্যুপরি পাহাড়ধসের আশঙ্কা আছে। ঝড়ের বাতাস ও টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়গুলো নরম ও ভঙ্গুর হয়ে গেলে ভূমিধস হতে পারে। সেখানে যাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজগুলো করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
রোহিঙ্গা শিবিরসহ আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় তৈরি করা স্থাপনাগুলোর ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। সেখানে এমন অনেক স্থাপনা আছে, যেগুলো নিয়ম মেনে ও শক্ত করে বানানো। কিন্তু এর নিচের যে পাহাড়ের ঢাল আছে, তা যদি কোনো কারণে দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে ওই পুরো স্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ের পর পুরো রোহিঙ্গা শিবির এলাকার কোথায় কী ধরনের ক্ষতি ও ঝুঁকি তৈরি হলো, তা খতিয়ে দেখতে হবে। যাতে ঝড় চলে যাওয়ার পর পাহাড়ধসের মতো বিপদ তৈরি না হয়।
প্রশ্ন :
সামগ্রিকভাবে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে সরকারের প্রস্তুতিকে কীভাবে দেখছেন?
মো. জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা ধরনের দুর্যোগ নিয়মিতভাবে মোকাবিলা করে আসছি। আমাদের দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে দক্ষতা গড়ে উঠেছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে এ ধরনের ঝড়ের পরে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি-সিপিপি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। তারা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায়, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের মতো পরিস্থিতির সময় স্থানীয়দের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া এবং মাইকিং করাসহ অনেক ধরনের ভূমিকা রাখে।
আমাদের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এ ছাড়া সেখানকার সরকারি-বেসরকারি প্রচুর স্থাপনা আছে, যেগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় নেওয়া যাবে। ফলে আমি বলব জনবল ও অবকাঠামোর দিক থেকে আমরা যথেষ্ট এগিয়ে আছি। তবে এগুলোকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে যথাসময়ে কাজে লাগাতে হবে। অনেকে ঝড়ের সময় তার বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে রাজি হয় না। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রশ্ন :
আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মো. জিল্লুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।