দুই মাসও গেল না। আবারও নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলো। প্রথম দফায় ভিক্টর মার্কোপোলোস নামের এক ভিনদেশি লোক ভিনদেশি এক কাগজে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানান দেন যে বাংলাদেশের মানুষের লাখ লাখ তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। বেচারা মাথা কুটে মরছিলেন খবরটা সরকারকে জানিয়ে ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে। পারেননি। সরকার টের পায়নি বা পেতে চায়নি।
এখন আবার টেলিগ্রাম চ্যানেলে পাওয়া যাচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের সব তথ্য। জাতীয় নির্বাচন কমিশন জোরগলায় বলছে, তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য ফাঁস হয়নি। তবে তারা শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। সেখান থেকে হতে পারে। এর আগেও তারা একই কথা বলেছে।
তবে ঘটনা হলো, ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়া নিয়ে না আছে সরকারের মাথাব্যথা, না নাগরিকের। কারণ, নাগরিকদের বড় অংশই জানেন না ব্যক্তিগত তথ্য হাতছাড়া হওয়ায় তাঁরা কী কী বিপদে পড়বেন।
অন্যদিকে, যাঁরা ব্যক্তিগত তথ্য হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন, তাঁরা জানেন না সরকারের কাছ থেকে তথ্য ফাঁস হলে তাঁরা কার কাছে যাবেন। এর প্রতিকার কী। কারণ, তাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ফোনে আড়ি পাতা বা সাইবার প্যাট্রোলিংয়ের (ভার্চ্যুয়াল জগতে নজরদারি) মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারী নাগরিকদের নাস্তানাবুদ করার কথা জানেন। এই কাজগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করে থাকে বলে ব্যাপক প্রচার আছে।
সরকারও ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে থোড়াই কেয়ার করে। এ কথা বলাই যায়। কারণ, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ায় কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমন খবর নেই। এ নিয়ে আলোচনা একরকম ঢেকেই গেছে সরকারদলীয় লোকজনের ভাষণে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর পর তাঁরা এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর প্রচারে ব্যস্ত। তাঁরা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের যুগ, এর মেয়াদ ২০৪১ সাল পর্যন্ত।
ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা বাস্তবায়নে সরকার ২০১৮ সালে সরকার জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা করেছিল। ওতে তারা বলেছে, এই নীতিমালার উদ্দেশ্য হলো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ‘স্বচ্ছ’, ‘দায়বদ্ধ’ ও ‘জবাবদিহিমূলক সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে জনগণের দোরগোড়ায় সব সেবা পৌঁছে দেওয়া।
এসব কাজ করতে বেশ কিছু করণীয়র কথাও নীতিমালায় আছে, যার মধ্যে একটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা, যেখানে তারা বলছে, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া, তথ্যের সংরক্ষণ, ব্যবস্থা ও নিরাপত্তায় যথাযথ নিয়মনীতি ও প্রমিত মান অনুসরণ করাসহ নয়টি কাজ করা দরকার। বাস্তবে একটিও যে ঠিকমতো করেনি। ঠিকঠাক হলে দুই দিন পরপর তথ্য ফাঁসের খবর বেরোত না।
ডিজিটাল বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্মেদ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে কী বোঝায়, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেছেন, সেখানে চারটি বিষয়—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, মাইক্রোচিপের নকশা করা ও উৎপাদন ছাড়াও সাইবার নিরাপত্তা গুরুত্ব পাবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে কী বলা আছে, তাঁর কথার ব্যাখ্যা খুঁজতে smartbangladesh.gov.bd নামে সরকারি ওয়েবসাইটে ঢুঁ দিই। ওয়েবসাইট আমাকে একটি টিউটোরিয়ালের দিকে নির্দেশ করল। আর সেখানে ক্লিক করে দুর্বোধ্য কিছু শব্দবন্ধ ছাড়া আর কিছু পেলাম না। যেমন স্মার্ট সিটিজেন বলতে কী বোঝায়, তার ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের সব নাগরিক হবে স্মার্ট, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি ইউনিভার্সাল ডিজিটাল আইডি থাকবে। নাগরিকেরা হবেন ডিজিটালি লিটারেট, ফলে তাঁরা সব ধরনের ডিভাইস ব্যবহারে সক্ষম হবেন এবং যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে শতভাগ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।’
দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে এখনো প্রায় ৪০ ভাগের প্রায়োগিক সাক্ষরতা নেই। এ থেকে তাঁরা কী বুঝবেন, আল্লাহ মালুম। স্মার্ট বাংলাদেশ হলে কি সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য ফাঁস হলে বা ইচ্ছা করে ফাঁস করা হলে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ পাবেন—এ খবর নেই। যদিও আমরা উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যাচ্ছি, এমন বক্তৃতায় কান ঝালপালা, যুক্তরাজ্যের ইনফরমেশন কমিশনের মতো আমাদের কমিশন কি কখনো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করবে?
তবে তথ্য ফাঁস বন্ধে আলোচনা তুলেছেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসির (সংক্ষেপে যাকে আপনারা আড়ি পাতা সেল বলতে পারেন) প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান। তিনি ফেসবুক পোস্টে তথ্য ফাঁস বন্ধে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ‘সরকারি কেন্দ্রীয় ডেটা সেন্টার’ কিংবা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডেটা সেন্টারে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মত দিয়েছেন। যদিও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই মনে করেন, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যে আরও বেশি হস্তক্ষেপের জন্যই সরকারি কেন্দ্রীয় ডেটা সেন্টারের আলোচনাটা উঠছে।
নাগরিক অধিকার কর্মীদের এমন ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আসলেই মানুষকে সাইবার নিরাপত্তা দিতে চায়, নাকি তাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান সরকারকে সুরক্ষিত রাখা, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে (দেখুন: ভিন্নমত দমনে জোর, অপরাধ ঠেকাতে নয় https://www.prothomalo.com/bangladesh/3btes7kazb)। যেমন এনটিএমসি সরকারের সঙ্গে যে বার্ষিক কর্মকৃতী (পারফরমেন্স) চুক্তি করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তারা মোবাইল ফোন, ল্যান্ডফোন , স্যাটেলাইট ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, পাশাপাশি অনলাইনে কনটেন্ট ব্লক (আধেয় আটকে রাখা) করা, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ‘অযাচিত’ আধেয় ব্লক করে থাকে। আর এসব কাজেই তারা এক শতে এক শ পেয়েছে। পিছিয়ে নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলোও।
ভার্চ্যুয়াল জগতে তথ্যের সুরক্ষার নামে বাহিনীগুলো নজরদারির জন্য কে কত প্রকল্প নিতে পারে ও কেনাকাটা করতে পারে, তা নিয়েও প্রতিযোগিতা আছে। যেমন কয়েক বছর আগে ‘র্যাবের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পের আলোচনায় এনটিএমসির পর্যবেক্ষণে আছে, র্যাবের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কিন্তু এতে ‘সার্ভিল্যান্স ডিভাইস, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার, জিওলোকেশন ট্র্যাকিং সিস্টেম, ভিজ্যুয়াল ডিরেকশন ফাইন্ডার’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বিস্তারিত সমীক্ষা হওয়া দরকার। কারণ, এনটিএমসির সঙ্গে প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ মিলে যাচ্ছে। এতে কাজের দ্বৈততা তৈরি হবে এবং অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল এসব সরঞ্জাম একাধিক সংস্থার জন্য কেনা হলে সরকারি অর্থের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ আবার অন্য এক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। কারণ, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো গোয়েন্দা কার্যক্রমের জন্য তারা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ নয় (সূত্র: বাংলাদেশ: ইন্টেলিজেন্স কালচার অ্যান্ড রিফর্ম প্রায়োরিটিজ—এ এস এম আলী আশরাফ), হলেও ক্ষতিবৃদ্ধি তেমন কিছু হতো না। সংসদে একটি রাজনৈতিক দলের একাধিপত্য এবং নামমাত্র বিরোধী দলের উপস্থিতিতে আর যা-ই হোক নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, গোপনীয়তার সুরক্ষা নিয়ে তোলপাড় হবে, এ শুধু দুরাশা নয়, অসম্ভবও।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক