ইরানকে কতটা বদলে দিতে পারবেন সংস্কারপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংস্কারপন্থী প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান কট্টরপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ জালিলিকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন।ছবি : এএফপি

ইরানের পরিস্থিতির একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংস্কারপন্থী প্রার্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান কট্টরপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ জালিলিকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন। তিন কোটিরও বেশি ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন।

পেজেশকিয়ান ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পাওয়ায় তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জালিলি পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট।

ইরানের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনের ফলাফল কি ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে? ইরানের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে এই ফলাফল কি কোনো প্রভাব রাখতে পারবে?

প্রথমেই অপরিহার্য যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া দরকার তা হলো, এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সেদিক থেকে ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতির নির্বাচন।

এত কমসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি বেশ কয়েকটি কারণকে সামনে নিয়ে আসে। যেমন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক জন–অসন্তোষ, প্রার্থীদের নিয়ে বড় ধরনের বিভ্রান্তি। বিস্তৃত অর্থে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি মোহভঙ্গ ও ঔদাসীন্যের মতো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।

আরও পড়ুন

চিকিৎসা ও রাজনীতি—দুই স্বতন্ত্র পথে পেজেশকিয়ানের কর্মজীবন কেটেছে। আজারবাইজানি ও কুর্দি ঐতিহ্যের একজন হার্ট সার্জন হিসেবে ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে  তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শুধু চিকিৎসক দল পাঠাননি, একজন যোদ্ধা ও চিকিৎসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পেজেশকিয়ান চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন এবং তাবরিজ বিশ্ববিদ্যালয় অব মেডিকেল সায়েন্সেসে জেনারেল সার্জারির ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ইরানের ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেস থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির ওপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন। সার্জারির ওপর এই অভিজ্ঞতার কারণে তাঁকে তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হয়। পাঁচ বছরের জন্য তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৪ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি স্ত্রী ফাতেমি মাজেদি ও এক কন্যাকে হারান।
১৯৯৭ সালে মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনে উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিক হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়। ২০০১ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেই পদে দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর তিনি ইরানের পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

এটা ইরানের সমাজের এই প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত দেয় যে নির্বাচনের মাধ্যমে কে এল, সেটা কোনো বিষয় নয়; কট্টরপন্থীরা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। সুতরাং দেশের ভেতরে সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে কথাবার্তার ধরনে বদল এলেও, ইরানের একেবারে মৌলিক কৌশল ও নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ইরানে কট্টরপন্থীদের যে শক্তিশালী ক্ষমতাকাঠামো, তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

তাবরিজ থেকে পাঁচবার তিনি পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত ইরান পার্লামেন্টে প্রথম ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ইরানের রাজনৈতিক পটভূমিতে বেশ কিছু কারণেই পেজেশকিয়ানকে সংস্কারপন্থী অথবা মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ বলা হচ্ছে। একই ধারার সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানির মতো তিনিও পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে।

পশ্চিমের সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্কের পক্ষে ওকালতির কারণ হলো, তিনি বিশ্বাস করেন, এতে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ খুলে যাবে। চূড়ান্তভাবে যা ইরানকেই শক্তিশালী করবে।

এ ছাড়া নানা সময়ে তিনি ইরান সরকার, বিশেষ করে যেভাবে তারা বিক্ষোভ দমন করেছে, তার সমালোচনা করেছেন। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্তৃপক্ষের কঠোর ব্যবস্থায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে নারীর অধিকার ও হিজাব আইন প্রয়োগের সময় যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতে তিনি উদ্বেগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই হিজাব আইনের প্রতি সম্মান দেখাব, কিন্তু সেটা জবরদস্তিভাবে চাপিয়ে দেওয়া কিংবা নারীদের প্রতি অমানবিক আচরণ আমাদের কখনোই করো উচিত নয়।’

আরও পড়ুন

এটা সত্ত্বেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। সেটা হলো, পেজেশকিয়ান ক্রমাগতভাবে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড ক্রপসকে (আইআরজিসি) সমর্থন করে গেছেন। ইরানের এই সামরিক সংস্থাকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা তিনি করেছেন। পার্লামেন্টে তিনি আইআরজিসির ইউনিফর্ম পরে এসেছেন। এর মানে হচ্ছে, প্রকাশ্যে তিনি আইআরজিসির প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট পদে পেজেশকিয়ানের প্রার্থিতার অনুমোদন দিয়েছে ইরানের অভিভাবক পরিষদ। দীর্ঘদিন ধরে যে টেকসই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পেজেশকিয়ান গড়ে তুলেছেন, তাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি তাঁর আনুগত্যের ইঙ্গিত দেয়।

পেজেশকিয়ান পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে ওকালতি করছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি ইরানের বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, বরং সেই ব্যবস্থা যাতে আরও টেকসই ও কার্যকর হয়, সেটাই তিনি চান। অন্য সংস্কারপন্থী ও মধ্যপন্থী নেতাদের মতোই তিনি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে (অবশ্যই মূলনীতি বজায় রেখে) শক্তিশালী করতে চান।

ইরানে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে পেজেশকিয়ানের কতটা সামর্থ্য আছে, সেই বিবেচনা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তাদের প্রত্যাশা নির্ধারণ করা। বাস্তবতা হলো, ইরানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিগুলো প্রধানত সর্বোচ্চ নেতা ও আইআরজিসির জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারের ওপর তাঁরা প্রভূত কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। অতীতে দেখা গেছে, খাতামির মতো সংস্কারপন্থীদের প্রচেষ্টাগুলো তাঁরা ঢেকে দিয়েছেন। এ কারণে পেজেশকিয়ানের মতো সংস্কারপন্থীরা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সংস্কার কিংবা নীতি পরিবর্তনের পক্ষে কথা বললেও, বাস্তবে সেটা করার সামর্থ্য তাঁদের সীমিত।

এ ছাড়া আঞ্চলিক নীতিতে ইরানের অবস্থান, প্রক্সিদের সমর্থন এবং পরমাণু ও ব্যালিস্টিক মিসাইল কর্মসূচির গতিপথ পরিবর্তন বলে মনে হয় না। ইরানের ইতিহাস বলছে, তথাকথিত সংস্কারপন্থী নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে, কট্টরপন্থীদের দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিক্রিয়া আসে। ফলে দমন–পীড়ন তীব্র হয়।

এটা ইরানের সমাজের এই প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত দেয় যে নির্বাচনের মাধ্যমে কে এল, সেটা কোনো বিষয় নয়; কট্টরপন্থীরা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। সুতরাং দেশের ভেতরে সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে কথাবার্তার ধরনে বদল এলেও, ইরানের একেবারে মৌলিক কৌশল ও নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ইরানে কট্টরপন্থীদের যে শক্তিশালী ক্ষমতাকাঠামো, তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

  • মাজিদ রাফিজাদেহ, হার্ভার্ড থেকে শিক্ষা শেষ করা ইরানি-আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত