উচ্চবংশীয় ছাগল–কাণ্ড থেকে কথিত পিতার কাণ্ড

ছাগল তো মোটেই হেলাফেলা করার মতো কোনো প্রাণী নয়। ছাগল নিয়ে গল্প-কৌতুকের সংখ্যাও কম নয়।

সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-এর সেই ছাগলটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। তার একটা নামও ছিল, ‘শ্রীব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ’। হযবরলতে তার আগমন এভাবে:
‘অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে একটা মস্ত দাড়িওয়ালা ছাগল হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, “আমার কথা হচ্ছে বুঝি”?’

আসলেই, ছাগলের কথাই হচ্ছে এখন। দেশজুড়েই ছাগল নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। যাকে নিয়ে এত কথা, কোরবানি ঈদের পরেও সে–ও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এখনো কারও উদরে যেতে পারেনি আলোচিত সেই ‘বিটল’ প্রজাতির ছাগল। তবে উদরপূর্তির আগে বিরল প্রজাতির ও বিরল দামের ছাগল নিয়ে কথাবার্তা তো হতেই হবে। ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল বলে কথা।

তা ছাড়া ছাগল তো মোটেই হেলাফেলা করার মতো কোনো প্রাণী নয়। ছাগল নিয়ে গল্প-কৌতুকের সংখ্যাও কম নয়। ছাগলের বুদ্ধি ও খাদ্যতালিকা নিয়েও কথাবার্তা কম হয় না। ছাগল নিয়ে কবিতাও লেখা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি। তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতার জগৎ মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তিনি একজন সাংবাদিকও ছিলেন। ‘পাঁটা’ নামে তাঁর একটি কবিতা আছে। সেই কবিতা ছিল এ রকম:
রসভরা রসময় রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।
স্বর্ণকুঁকী রত্নগর্ভা জননী তোমার।
উদরে তোমার ধরে ধন‍্য গুণ তার।।
তুমি যার পেটে যাও সেই পুণ‍্যবান।
সাধু সাধু সাধু তুমি ছাগীর সন্তান।।

আমরা যে ছাগীর সন্তান নিয়ে আলোচনা করছি, তাকে তিনবার সাধু সাধু সাধু বলাই যায়। ঘটনাটি এরই মধ্যে নিশ্চয়ই সবার জানা হয়ে গেছে। মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের একজন কোরবানি ঈদের আগে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। সেখানে একটি ছাগল পাশে রেখে ওই তরুণকে বলতে শোনা যায়, ‘এ রকম একটি খাসি কেনা আমার স্বপ্ন ছিল। এ রকম খাসি আমরা সামনাসামনি দেখিনি। আমার জীবনে প্রথম দেখা। এটি আমার হবে, জানা ছিল না। আল্লাহ নসিবে রাখছে, তাই হইছে। এর থেকে বেশি কিছু আর কী বলব!’

ছাগলটি কেনা হয়েছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরের ‘সাদিক এগ্রো’ ফার্ম থেকে। তারা এখন বলছে, ‘সেই তরুণ শুধু এক লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটি কিনবেন বলে বুক করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পুরো টাকা পরিশোধ করে ছাগলটিকে খামার থেকে বাড়িতে নিয়ে যাননি।’ হয়তো ভাইরাল হওয়ার পরে পরিচয় প্রকাশে দ্বিধা থেকেই আর কেনা হয়নি। ভাইরালের মূল্য দাঁড়াল তাহলে এক লাখ টাকা।

সাদিক অ্যাগ্রোই বলছে, এই ছাগলের দাম এত বেশি, কারণ এটি উন্নত জাত এবং উচ্চবংশীয়। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে ছাগলের ক্রেতার বংশপরিচয় নিয়ে। কোরবানি ঈদের আগে অনেকেই কেনা দামি গরু বা ছাগলের ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। অনেকেই এটা পছন্দ করেন না। তখন রসিকতা করে কেউ কেউ লেখেন, ‘ক্যাপশন না দিলে বোঝা যায় না কোনটি গরু আর কোনটি আপনি।’ নতুন করে যা ছাগল–কাণ্ড হয়েছে, তাতে হয়তো ভবিষ্যতে উচ্চবংশীয় গরু বা ছাগলের সঙ্গে উচ্চবংশীয় ক্রেতার পরিচয়ও চাইতে হবে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ছাগল–কাণ্ড থেকে এখন বিষয়টি শেয়ারবাজার–কাণ্ডে রূপ নিয়েছে। গায়ক আবু বকর সিদ্দিকের সেই গানটা এখন নতুন করে শোনা যায়, ‘মরি হায় রে হায় দুঃখে আগুন জ্বলে, হাজার টাকার বাগান খাইলো পাঁচ সিকার ছাগলে।’

বিপত্তিটি দেখা দিয়েছে মুশফিকুর রহমান ইফাতের বংশপরিচয় নিয়ে। ফেসবুকে একদল দাবি করলেন তিনি মতিউর রহমান নামের একজন উচ্চপদস্থ রাজস্ব কর্মকর্তার পুত্র। এখন মতিউর রহমানকে জনে জনে বলতে হচ্ছে তিনি এই মুশফিকুর রহমানের পিতা নন। এতেও খুব একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে ফেসবুকবাসীর ধারণা, নিজের বিপুল সম্পদ আড়াল করতে পিতা পুত্রকে অস্বীকার করছেন। সুতরাং এখন থেকে কেউ যদি দামি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি বা উচ্চ বংশের গরু–ছাগলের ছবি দেন, তাহলে কে কোনটি, তা তো লিখে দেবেনই, একই সঙ্গে পিতার নামসহ নিজের বংশপরিচয়ও দিয়ে দেবেন। তারপর বাকি কাজ দুর্নীতি দমন কমিশনের।

মতিউর রহমান এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য। টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভিতে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে নিজের অবস্থান বর্ণনা করেছেন। পুরো সাক্ষাৎকারের শেষ অংশে এসে থমকে যেতে হলো। সেখানে তিনি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির বর্ণনা দিয়েছেন। আয়ের উৎসের কথাও বলেছেন। প্রশ্ন উঠছে, তাঁর এই বক্তব্য নিয়েও।

মতিউর রহমানের হুবহু বক্তব্য এ রকম: ‘আমি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করি ২০০৮ সাল থেকে।

ফরচুন শুজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, আমার এক ছোট ভাইকে বললাম তাদের নিয়ে আসেন। তারপর তাদের সঙ্গে আমি বসলাম। এই একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ অবিশ্বাস্যরকমের ভালো মুনাফা পেয়েছিলাম। ৮ টাকার শেয়ার ৫৪ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার কন্ট্রাক্ট হয়েছিল যে আমাকে ৮ টাকা দরে শেয়ার দেবেন। যেটা আমি ফুল কনসালট্যান্সিতে করেছিলাম। একদিকে আমি আইপিওর কাজ শুরু করেছিলাম।

‘আরেকটা দিক হচ্ছে আমি সব সময় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের থেকে আলাদা ছিলাম। আমি যা করি তা হচ্ছে, প্রতিবছর আমি দেখি যে কোন কোম্পানিটা সম্ভাবনাময়। কিন্তু কোনো একটা কারণে হয়তো খারাপ অবস্থায় আছে। সেই কোম্পানির সঙ্গে মালিকসহ বসি, তাদের কোম্পানি পরিদর্শন করি, তাদের খারাপ অবস্থা কেন, সেটা বের করি, এরপর দেখি কীভাবে তাদের উন্নতি করা যায়। খারাপ অবস্থায় আমি শেয়ারটা কিনি, কোম্পানির উন্নতির পরে সেই শেয়ার বিক্রি করি। এর ফলে একটা ভালো লাভ হয়।

‘যেমন একটা উদাহরণ দিই। এই মুহূর্তে আমরা কাজ করছি সিলভা ফার্মা নামের একটা ওষুধ কোম্পানি নিয়ে। সামনে কোম্পানির বৃদ্ধি বাড়বে তিন গুণ। এই বৃদ্ধিটা হবে আগামী এক বছরে। এই তথ্যটা আপনি জানলেন। তারপর সেই বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করলেন। ব্যবস্থাপকদের সহযোগিতা করলেন। এখন যেমন সিলভা ফার্মার দাম আছে ১৬-১৭ টাকা। এই শেয়ারটা কিন্তু এক বছরে হয়ে যাবে ৩০-৩২ টাকা। যারা এভাবে বিনিয়োগ করে, মার্কেট ভালো-খারাপ যা–ই থাকুক। তারা কিন্তু শেয়ার কিনে মুনাফা করতে পারে। আমি সব সময় এভাবে সুচিন্তিত বিনিয়োগ করি।’

মতিউর রহমানের এই বক্তব্য এবার বিশ্লেষণ করা যাক। ফরচুন শুজের শেয়ার তিনি পেয়েছিলেন ৮ টাকা দরে। ফরচুন শুজ বাজারে প্রাথমিক শেয়ার (আইপিও) ছাড়ার জন্য প্রসপেক্টাস প্রকাশ করেছিল ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই। এর অভিহিত মূল্য ছিল ১০ টাকা। এর অর্থ মতিউর রহমান অনেক কম দামেই এর শেয়ার কিনতে পেরেছিলেন। যাকে বলা হয় ‘প্লেসমেন্ট’-এর শেয়ার।

সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান বলেছেন, তিনি কোম্পানির ব্যবস্থাপক ও মালিকদের ডাকতেন, বুদ্ধি–পরামর্শ দিতেন, কোম্পানি পরিদর্শনে যেতেন, বৃদ্ধির উপায় বাতলে দিতেন। অর্থাৎ পরামর্শকের কাজ করতেন। তাতে কম দামে শেয়ার পেয়েছিলেন। এনবিআরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এটা পারেন কি না, সেই প্রশ্ন তো আছেই। উল্টো দিকে এসব কোম্পানি এনবিআর থেকে বাড়তি কোনো সুবিধা পেয়েছিল কি না, সে প্রশ্নও উঠবে এখন। আমরা আরও জানি, কয়েক বছর ধরেই ফরচুন শুজ নিয়ে ব্যাপক কারসাজি হয়েছে এবং তাতে লাভবান হয়েছেন এসব কারসাজিকারীরা।

সাক্ষাৎকারে তিনি সিলভা ফার্মার কথা বলেছেন। তিনি এখন কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি জানেন এক বছরে কোম্পানিকে আরও বড় করা হবে। ফলে এর আকার তিন গুণ বাড়বে। এখন এই কোম্পানির শেয়ারদর হচ্ছে ১৬ টাকা ৪০ পয়সা। মতিউর রহমান জানাচ্ছেন এই দর ৩০ টাকার বেশি হবে। কারও যদি এভাবে ভেতরের খবর বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানার সুযোগ থাকে, আর তিনি যদি এই কোম্পানির শেয়ার কেনেন বা অন্যকে কিনতে পরামর্শ দেন, তাহলে তাকে ইনসাইডার ট্রেডিং বলে, যা আইনত অপরাধ। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আইনেই তা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এখন যদি বিনিয়োগকারীরা দলে দলে সিলভা ফার্মার শেয়ার কিনতে থাকেন, তাহলে এক বছর লাগবে না, অল্প কয়েক দিনেই এর দর ৩০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে দর বাড়ানোকে শেয়ারবাজারের ভাষায় কারসাজি বলে। এটাও অপরাধ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ছাগল–কাণ্ড থেকে এখন বিষয়টি শেয়ারবাজার–কাণ্ডে রূপ নিয়েছে। গায়ক আবু বকর সিদ্দিকের সেই গানটা এখন নতুন করে শোনা যায়, ‘মরি হায় রে হায় দুঃখে আগুন জ্বলে, হাজার টাকার বাগান খাইলো পাঁচ সিকার ছাগলে।’

  • শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন