কয়েক পদের শাক—ঢেঁকিশাক, পাটশাক, কচুশাক। আছে কচু ফুল, পাশে মেহেদি। সব মিলিয়ে গোটা দশ-বারো আঁটি। সেগুলো ভাগে ভাগে সাজানো জীর্ণ একটি বেঞ্চের ওপর; বেঞ্চটি ফুটপাত ঘেঁষে সড়কে রাখা। এক বৃদ্ধা বসে আছেন ফুটপাতের অপর পাশের দোকানের সিঁড়িতে। তাঁর পোশাকের মলিনতা, পাশে রাখা কয়েকটি ছেঁড়াখোঁড়া বস্তা-থলে, শত আঘাত সয়ে টিকে থাকা এবড়োখেবড়ো একটি দুই-আড়াই লিটারের পানির বোতল, সর্বোপরি তাঁর ‘অভিব্যক্তি’ই বলে দিচ্ছে, ওই বেঞ্চখানাসহ শাক-লতাপাতার তিনিই মালিক। তিনি কি জানেন, এই দেশেরও মালিক তিনি?
সড়কটি পুব-পশ্চিমে লম্বা বলে রোদ পড়ে দিনের প্রথম প্রহর থেকেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তেজ বাড়ে এবং জায়গা বদলাতে বদলাতে আরও মাথার ওপর চলে আসে। কারণ, দক্ষিণে সড়ক ঘেঁষে বহুতল ভবন নেই। তাই সিঁড়িতে বসা শাক বিক্রেতা বৃদ্ধার মাথাটার ওপর কোনোমতে দোকানের শেডের একটু ছায়া ঝুলে আছে, গোটা শরীর রোদে পুড়ছে।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর সাড়ে ১২টা পেরিয়ে গেছে। একে পবিত্র আশুরার ছুটি (৯ আগস্ট), দুইয়ে বর্ষা নামে ‘রোদ-বর্শা’র দাপট। এবারের বর্ষা মানে তো আর ‘বৃষ্টিবাদলা’ নয়, পঞ্জিকায় পাতায় আটকে থাকা যেন এক অচেনা ঋতুর নাম। তাই রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি আঙুলেই গোনা শেষ হয়ে যায়।
এই শাক বিক্রেতা বৃদ্ধার আয়-রোজগারের হিসাবও, দেখলাম, আঙুলেই দিব্যি কষা হয়ে যাচ্ছে; ক্যালকুলেটরের কোনো কাজ নেই এখানে। জানালেন, থাকেন বেড়িবাঁধের ওপারে ঢালচরে। সেখান থেকে সাতসকালে টেম্পোতে যান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে; সাদেক খান বাজারে। সেখান থেকে শাক কিনে রিকশায় করে আসেন জিগাতলায়। বেচাবিক্রি শেষে ফিরে যান ঢালচরের এক কামরার ভাড়া বাসায়। রোদ-বৃষ্টি, ঠান্ডা-গরম এবং একাল ও সেকাল—সব কালে এই এক রুটিন তাঁর।
শুধু কি নামেই ভুল তাঁর? ‘ভুল’ সময়ের মানুষও কি তিনি নন? নইলে আস্ত দেশের মালিকানায় হিস্যা থাকার পরও কি তিনি তার এতটুকু ‘ভোগ’ করতে পারছেন? ১০ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বললেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’
বললেন, ‘দ্যাশ স্বাধীন হইল রবিবার, আমি ঢাকায় আইলাম সোমবার’। পরে গুগল করে দেখলাম, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। তাই তখন তাঁর স্মৃতি থেকে বলা কথার পিঠে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকার আসার পর তাঁর বিয়ে, চার মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম, প্রতিটি দিন একই লড়াই জারি রাখা এবং এখনো এই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও নিজের মুখের খাবারটুকু নিজের জোগাড়ের জন্য যে সংগ্রাম, তার সামনেও মুখে কোনো কথা জোগাল না। অথচ একটু-আধটু পরিসংখ্যান, অঙ্ক, হিসাব যে জানা নেই, তা তো নয়। যেমন মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলারের বেশি, জিডিপির ‘কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি’, ধনীর সংখ্যায় রেকর্ড, রেমিট্যান্স। কত শত মেগা প্রকল্পের গল্পও তো শুনতে শুনতে মুখস্থ।
তবু জিব বেইমানি করল, যখন তিনি বলছিলেন, ‘বাবা রে, চালান তো বেশি না, পাঁচ শ টাকার মতো’, তাই দিয়ে শাকপাতা কেনেন। আগে সাদেক খান বাজার থেকে ৩০-৪০ টাকায় রিকশায় আসা যেত জিগাতলায়। সব জিনিসের দাম এত বাড়তি যে এখন ১০০ টাকার নিচে কোনো রিকশাওয়ালা আসতেই চান না। বিক্রিবাট্টা করে কোনো দিন লাভ থাকে ১০০ টাকা, কোনো দিন বা ৫০-৬০ টাকা। কপাল ভালো হলে দেড় শ টাকা হাতে ওঠে।
তাহলে দিন চলে কীভাবে? ঘরভাড়ার তিন হাজার টাকা ছেলে দেন বলে রক্ষা। ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন সাভারে, একটি চামড়ার কারখানায় কাজ করেন। চার মেয়ের বিয়ে হয়েছে; তাঁরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। স্বামী গত হয়েছেন ১৫-১৬ বছর আগে। শাক বিক্রি করে যা আয় হয়, তাই দিয়ে দুটো ডালভাত খান। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে বুঝি নুনভাতও আর না জোটে!
নাম বললেন, ‘খাদেজা বেগম’। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ১৬ কি ১৭। বাবার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায়ই কেটে গেল জীবন। কথার এক ফাঁকে তাঁর চটের ব্যাগ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বের করে দেখালেন। তাতে নাম লেখা ‘খাদিজা বেগম’; অথচ উনি বলছিলেন ‘খাদেজা বেগম’। আহা রে! একজন মানুষ প্রায় আশি বছরের জীবন কাটিয়েও তাঁর সঠিক নামটি জানেন না, বা তাঁর সঠিক নামটি সরকারের খাতায় নেই!
শুধু কি নামেই ভুল তাঁর? ‘ভুল’ সময়ের মানুষও কি তিনি নন? নইলে আস্ত দেশের মালিকানায় হিস্যা থাকার পরও কি তিনি তার এতটুকু ‘ভোগ’ করতে পারছেন?
১০ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বললেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’
খাদিজা বেগম বলছিলেন, ‘আমাগো দিন যে ক্যামনে চলে, তা আল্লাই জানেন!’ না, খাজিদা বেগম আপনি ‘ভুল’ বলেছেন। ‘ভুল’ সময়ের মানুষ বলেই হয়তো আপনার এমন ভুল হচ্ছে! মাননীয় মন্ত্রীও জানেন। এই নিবন্ধকারও সাক্ষী, আপনার পরনে শাড়ি ছিল, হোক তা জীর্ণ। অতএব আপনি ‘খুব খারাপ অবস্থায়’ নেই।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক [email protected]