খুদে বার্তায় পুলিশের অনুরোধ, ভালো বিষয় তবে...

পানির মধ্যে লাফিয়ে নামছে এক শিশু। গতকাল বেলা ১১টায় মিরপুরের কাজীপাড়ায়ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভারী বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা তলিয়ে গেছে। রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গাড়ি বিকল হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় নগরবাসীকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হাতে সময় নিয়ে বের হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ নগরবাসীর কাছে খুদে বার্তা পাঠায়।

আপাতদৃষ্টিতে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে স্মার্ট নাগরিক-সেবার উদাহরণ হতে পারে এটি। তবে এ–জাতীয় খুদে বার্তা যতই ভালো হোক, এটি যে সমস্যার সমাধান নয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার না করলেও বিশ্বাস করেন আশা করি।    

বৃষ্টিতে রাস্তা তলিয়ে যাওয়া বা গাড়ি বিকল হয়ে যানজট সৃষ্টি হওয়ার কারণ হিসেবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের পরিমিতিবোধহীন বৃষ্টিকে দোষ দিয়ে সাময়িকভাবে আমরা স্বস্তি বোধ করি। বেচারা বৃষ্টি! হলেও দুর্গতি, না হলেও দুর্ভোগ।

বৃষ্টিকে যেহেতু কান ধরে পরিমিতিবোধ শেখানোর উপায় নেই কিংবা সপ্তাহের কোন দিন কতটুকু ঝরবে, সেই রুটিন পিটিয়ে মুখস্থ করানোর পথ নেই, সেহেতু রাজধানীর দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তা-কর্ত্রীরা রাস্তা তলিয়ে যাওয়া বা যানজট সৃষ্টির কারণগুলো নির্ণয় ও সমাধানের জন্য একটু দায়িত্বশীল আচরণ করলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

আসল বিষয়টা যে বৃষ্টি নয়, অন্য কিছু, সেটা যতই স্মার্ট পদ্ধতিতে খুদে বার্তা পাঠানো হোক, এ দেশের আনস্মার্ট আপামর মানুষ তা বোঝেন। এবং যানজট বা রাস্তা তলিয়ে যাওয়ার কারণগুলো যে এক দিনে তৈরি হয়নি, তা-ও তাঁরা জানেন।

আমাদের দেশের কর্তা-কর্ত্রীরা সড়ক, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি শরণার্থী ব্যবস্থাপনা শিখতে কিংবা বাইরের উত্তম পদ্ধতি দেখতে আ তা নিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অথবা প্রশিক্ষণ গ্রহণের কিংবা সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য ধারাবাহিকভাবে বিদেশ সফর করে থাকেন (স্বীয় অর্থে নয়, রাষ্ট্রীয় কিংবা বিদেশি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায়)। যেসব দেশ সফরকারীদের পছন্দের তালিকার শুরুর দিকে থাকে, তার মধ্যে সিঙ্গাপুর, হংকং ইত্যাদি অন্যতম।

কিন্তু এসব দেশ থেকে ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতা নিজ দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয় কি? অন্তত বিদেশ সফরের সময়ে রাস্তাঘাটে বের হলে তো আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের তুলনায় চোখে পড়ার মতো পার্থক্য লক্ষ্য করার কথা এবং আমাদের দেশে কীভাবে রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো করা যায়, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ ভাবনার উদয় হওয়ার কথা।

যা–ই হোক, মাত্র এক শ বছর আগেও সিঙ্গাপুরের পাবলিক বাসে চড়া একটি দুঃস্বপ্নের ব্যাপার ছিল। বাস কোম্পানিগুলো নিজেদের মুনাফার জন্য যখন যেমন খুশি নিয়ম প্রবর্তন করত এবং যাত্রীর হয়রানিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি ব্যবসা করে যেত। বিপুলসংখ্যক বাস কোম্পানিকে ১৯৩৫ সালে মিউনিসিপ্যাল অর্ডিনেন্সের আওতায় প্রায় জোরপূর্বক একীভূত করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে ১২টি, তারপর ১১টি, এরপর ৪টি এবং ১৯৭১ সালে ৩টি কোম্পানিতে রূপ দেওয়া হয়।

৩৫ বছরের এ চেষ্টার পথটি মসৃণ ছিল, তা নয়। ধর্মঘট, দুর্নীতি, মারামারি—সবই ছিল। কিন্তু আইনের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র কিছু করেনি। সেই তিনটি বাস কোম্পানিকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে সরকার সিঙ্গাপুর বাস সার্ভিস গঠন করে, যা আজকের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সে দেশের মানুষের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ও চমৎকার ট্রাফিক তৈরিতে সাহায্য করেছে।

উল্লেখ্য, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিযুক্ত শাসনব্যবস্থার কারণেই তাদের সড়ক বিভাগ তথা ট্রাফিকব্যবস্থা বাসচালক বা বাস মালিক সমিতির স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়নি। সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্সের বার্ষিক সড়ক পরিস্থিতির যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, তাতে এর আগের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সড়কের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কী কী করা হয়েছে, তা যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনি মদ্যপানের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে নাকি গতিসীমা না মানার কারণে বেড়েছে, তা-ও উল্লেখ থাকে।

গতকালের জলাবদ্ধতায় সড়কে অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। পানি ঢুকে অচল হয়ে পড়া অটোরিকশা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন চালক। বেলা ১১টার দিকে গ্রিনরোডে
ছবি: প্রথম আলো

খুদে বার্তায় যদি সমস্যার সমাধান লুকায়িত থাকত, তাহলে যুগে যুগে নীতি প্রণয়নের ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন হতো না। শুধু একটি উদাহরণই আশা করি যথেষ্ট। প্লাস্টিক ব্যাগ–পলিথিন দিয়ে নগরের নর্দমাগুলো যে ভরে থাকে, সেটি পরিষ্কার করানো যেমন নগর পিতা-মাতার দায়িত্ব, তেমনি নাগরিক যেন এ জাতীয় ক্ষতিকর আচরণ থেকে বিরত থাকার ধারণা শৈশব থেকেই পায়, তা শিশুশ্রেণিগুলোর পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত থাকাও আবশ্যক।

পরিহাসের বিষয় হলো, আমাদের শিশুরা পাঠ্যবইয়ে যা শেখে বাস্তবে দেখে তার উল্টো। যেমন শিশু হয়তো বইতে শিখছে রাজপথে লালবাতি-সবুজ বাতির ব্যবহার। পথে বের হওয়ার পর ইন্টারসেকশনে দেখছে উল্টো—হয় কোনো বাতি জ্বলে না অথবা দণ্ডায়মান পুলিশ অবিরাম ডান হাত-বাঁ হাত নাড়িয়ে গাড়ি চলার-থামার নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে সবুজ বাতিতে গাড়ি থামছে, আর লাল বাতিতে চলছে। শিশুমনে এমন দৃশ্য দর্শনে কী অনুভূত হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

খুদে বার্তার অনুরোধ অনুযায়ী সময় হাতে নিয়ে বের হতে হলে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যকে (যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই এবং বাস, রিকশা, পা হচ্ছে গন্তব্যে যাওয়ার মাধ্যম) কয়েক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে জাগতে হবে। কারণ, সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে। সেই পরিবারের কর্তা-কর্ত্রীর বাসা যদি হয় উত্তরা এবং কর্মস্থল হয় মতিঝিল, তাহলে তাঁকে নয়টায় অফিসে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হলে শীত-গ্রীষ্মের সময় নির্বিশেষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পথে নামতে হবে।

আর বাংলাদেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারকারী মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা খুদে বার্তা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা। আর সে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ, অসুস্থ, শিশু কিংবা প্রতিবন্ধী সদস্য থাকলে তাঁদের আহার-পথ্য খাওয়ার রুটিনেও পরিবর্তন আনতে হবে খুদে বার্তার অনুরোধ রক্ষার্থে। তবে অনেকে বলতে পারেন, এখন তো মেট্রোরেল চালু হয়েছে। কিন্তু প্রায় দুই কোটির একটি রাজধানী শহরে একটি মাত্র মেট্রোরেল সার্ভিস কতটা চাহিদা পূরণ করতে পারে সেই বিবেচনাও থাকল।  

নগরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যকর না করা, রাস্তা মেরামত না করা, যানজট ও যেখানে সেখানে বাস দাঁড়িয়ে রাখার স্বাধীনতা, পার্কিং ছাড়া ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া, ব্যক্তিমালিকানায় গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি হতে দেওয়া, যখন-তখন একজন-দুজন ভিআইপি যাবেন বলে দীর্ঘ সময় হাজার হাজার অ-ভিআইপিদের চলাচলের পথ বন্ধ রাখা, সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির নামে রাস্তার আকৃতি ছোট করা কিংবা রাস্তার মাঝখানে একটা গাড়ি নষ্ট হলে সেটি সরানোর জন্য দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারা ইত্যাদি কারণগুলো কিন্তু বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

এগুলো একটা শহরকে ‘শহর’ হিসেবে বাসযোগ্য করার ন্যূনতম পূর্বশর্ত। এসব শর্ত পালন করা এবং করানোর কথা তাদের, যারা শহরকে রক্ষার কোনো না কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত, তা অনেক ভোরে রাজধানীর রাজপথ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে ওপরের দিকের সব্বাই। নাগরিকসহ।

জবাবদিহি ব্যবস্থার অভাব সব সময়ই নিজের অক্ষমতা, কাজে ফাঁকি দেওয়ার পথ খোঁজা, কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়। অহেতুক বৃষ্টিকে অজুহাত বানানো তাই চতুরতা বা মূঢ়তা। একটু একটু করে ঢাকা শহরের বারোটা বাজানোর পরও, সব দিক দিয়ে পরিবেশের চরমভাবে ক্ষতি করার পরেও এখানে এখনো বৃষ্টি নামে, সেটাই তো বিস্ময়কর।

যানজট থেকে মুক্তির জন্য নাগরিককে সময় হাতে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার বুদ্ধি দেওয়ার কথা ভাবেনি বলেই অসলো, স্টকহোম, জুরিখ, সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে হংকং সফল সড়ক ব্যবস্থাপনার উদাহরণ হতে পেরেছে। তারা তাদের শহরে গাড়িমুক্ত এলাকা করেছে, পায়ে হাঁটার মতো দীর্ঘ পথ রেখেছে।

সুতরাং খুদে বার্তায় সময় হাতে নিয়ে পথে নামার অনুরোধের বদলে নগরের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজের দাপ্তরিক কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারলেই পলিথিনে ড্রেন বন্ধ হবে না কিংবা রাস্তার মাঝে থামিয়ে রাখা বাসের চালকের দাপটে বাসের পেছনে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে রোগী কাতরাতে থাকবে না এবং অঝোর বৃষ্টিতেও পানি না জমা পথে বিকল না হওয়া গাড়িতে চলাচল করতে পারব। আর নাগরিককেও আতঙ্কে থাকতে হবে না, কর্মস্থলে কখন রওনা দেব—এ রকম ব্যক্তিগত বিষয়ে খুদে বার্তার পর না জানি কখন ঘরে ফিরব, সে বিষয়েও খুদে বার্তা আসে।

  • ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়