কবিতা যখন রাজপথে

ছবি: দীপু মালাকার

ছয় দিন পর অটোরিকশা নিয়ে রোজগারের আশায় বের হয়েছিলেন ওবায়দুল নামের একজন অটোরিকশাচালক। কাজলার রাস্তায় পৌঁছাতে দুজন লোক তাঁকে বলল, একটি কিশোরের গুলি লেগেছে, হাসপাতালে নিতে হবে। 

ওবায়দুল তাকিয়ে দেখেন সেই কিশোর তাঁরই ছেলে আমিন, ততক্ষণে মৃত ও নিথর।

উত্তরার আজমপুর এলাকায় এক তরুণকে দেখা গেল রাস্তার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বারবার জানতে চাইছে, ‘পানি লাগবে কারও, পানি?’ এর ১৫ মিনিট পর গুলিবিদ্ধ মুগ্ধ নামের সেই মেধাবী তরুণটি লুটিয়ে পড়ল প্রকাশ্য রাস্তায়, স্রেফ পানি দেওয়ার ‘অপরাধে’!

১৬ বছর বয়সের কিশোর ফারহান ফাইয়াজ নিজের ফেসবুকের ইন্ট্রোতে লিখেছিল, ‘একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে তো চলে যেতে হবে। তাই এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পরও মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ 

সেই কিশোরের মরদেহ পড়ে ছিল রাজধানীর ধানমন্ডির রাজপথে। রক্তে স্নাত ছোট্ট সেই শরীর।

মৃত্যুর এক দিন আগে ফেসবুকে লিখেছিল আবু সাঈদ, একজন ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের। এর এক দিন পরই সেই গর্বের অংশীদার হয়ে নিজের আইডল শিক্ষকের মতো একজন শহীদ হয়ে বাংলার আকাশে মিশে গেল ছেলেটি।

আর তারও পরে পুলিশের প্রিজন ভ্যানের ফুটো দিয়ে শোনা যেতে থাকল এক কিশোরের আর্তনাদ, ‘আমার বোনটাকে বাসায় তালা দিয়া আসছি, আঙ্কেল, আমার বোনটাকে মুক্ত কইরেন!’

আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা জানি, এই সংলাপ বা দৃশ্যকল্পগুলো কত অনায়াসেই একেকটি মহৎ সৃষ্টির উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। 

একজন কবি বা একজন কাহিনিকার, কিংবা একজন চলচ্চিত্রকার এমন একেকটা দৃশ্যকল্পের জন্য বহু বছর ধরে অপেক্ষা করতে পারেন। এ যেন কাফকার উপন্যাস, বিশ্বাস হতে চায় না যে এমনটা ঘটেছে বা ঘটতে পারে।

কিন্তু আমরা লিখতে পারছি কই! বাস্তব যখন ফিকশনের চেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়ে ওঠে, তখন কলম এভাবেই নিশ্চুপ হয়ে যায়। কবিতা যখন রাজপথে নেমে আসে, তখন অক্ষরের আর কী করার আছে?

গত জুনের মাঝামাঝি এসব তরুণ যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে পথে নেমেছিল, তখন তাদের এই শহরের অনেকে হয়তো লক্ষই করেনি রোজকার ব্যস্ত জীবনযাপনে।

পেশার তাগিদে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া সায়েন্স ল্যাব বা শাহবাগ মোড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় দেখেছি, রাজপথে বসে বা দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে তরুণেরা, তাদের দাবি খুবই সাধারণ ও ন্যায্য, সরকারি চাকরির কোটা যেন পুনর্বিন্যাস করা হয় সময়ের তাগিদে।

পথ চলতে চলতে ভেবেছি, সমাধান নিশ্চয় দ্রুতই হবে, আদালত একটি দিকনির্দেশনা দেবেন, সরকার সমাধান করবে বিষয়টি, আর আন্দোলনকারীরাও ফিরে যাবে যার যার শিক্ষাক্ষেত্রে। 

আশ্চর্য, এই শক্তি, এই শৌর্য, এই কণ্ঠ আমরা আগে শুনতে পাইনি কেন? আমরা তো মেনেই নিয়েছিলাম যে এভাবেই চলবে সবকিছু; আমাদেরই রক্ত-ঘামে-শ্রমে উপার্জন করা কোটি কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে প্রাসাদ গড়বে কেউ কেউ, অথচ আমরা কিছু বলতে পারব না, ক্ষমতাবানের আস্ফালনের সামনে মাথা নত করেই দিন যাপন করে যেতে হবে চিরকাল আমাদের।

একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা তো শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমেই দেখতে চাই সব সময়।

ঘুণাক্ষরেও তখন ভাবিনি, এসব তরুণ একেকজন হয়ে উঠবে চে র সেই সবুজ নোটবুকের কবিতা, ‘এক সাহসী ক্যাপ্টেনের মতোই তোমার ছোট্ট মৃতদেহখানি।’ আমরা ভাবিনি তারা রাজপথে ফোটাবে নেরুদার বসন্তের ফুল—‘তুমি ফুল ছিঁড়তে পারবে ঠিকই, কিন্তু বসন্তের আগমন ঠেকাতে পারবে না।’ আমরা ভাবিনি তাদের কণ্ঠ ভেঙে বেরিয়ে আসবে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’। 

আশ্চর্য, এই শক্তি, এই শৌর্য, এই কণ্ঠ আমরা আগে শুনতে পাইনি কেন? আমরা তো মেনেই নিয়েছিলাম যে এভাবেই চলবে সবকিছু; আমাদেরই রক্ত-ঘামে-শ্রমে উপার্জন করা কোটি কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে প্রাসাদ গড়বে কেউ কেউ, অথচ আমরা কিছু বলতে পারব না, ক্ষমতাবানের আস্ফালনের সামনে মাথা নত করেই দিন যাপন করে যেতে হবে চিরকাল আমাদের।

ভোটের অধিকার, সম্মানজনকভাবে বাঁচার অধিকার, কথা বলার অধিকার, সুবিচার পাওয়ার অধিকার ছাড়াই আমরা হয়তো টিকে যেতে পারব একটা জীবন কোনোমতে। 

এভাবেই তো চলছিল সব। কিন্তু এর মধ্যে এই অমিত তেজস্বী প্রজন্ম কোত্থেকে জন্ম নিল? কীভাবে বেড়ে উঠল? কোথায় বেড়ে উঠল? ১৮ বা ১৯ জুলাই যেমন অবিশ্বাস্য ছিল আমাদের কাছে, ওই নির্বিচার গুলি, নির্বিকার হত্যা আর ক্ষমতাবানদের ব্যঙ্গ-মকারি-উপহাস যেমন হতবাক করে দিয়েছিল তখন আমাদের, তার পরবর্তী দিনগুলো ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে আরও অবাক করা, আরও আশ্চর্য, আরও অভূতপূর্ব। 

আমাদের আবদ্ধ চোখের ঠুলি খুলে দিয়েছে তারা। আমরা এখন সত্যি বুঝতে পারছি, ঠিক কী রকমভাবে আমরা বেঁচে আছি, এবং ছিলাম! 

জুলাইয়ের সেই অবিশ্বাস্য মেটাফোরগুলোর দিন থেকে রোজই ভাবি, ওদের নিয়ে কিছু লিখব। একটা গল্প, কিংবা কবিতা। কিংবা দুই লাইনের শোকগাথা। কিন্তু সে সাহস হয়নি। কারণ, রোজই তারা নতুন নতুন কবিতা লিখে চলেছে রাজপথে আর দেয়ালে দেয়ালে, এমনকি পুলিশের সাঁজোয়া যানে।

১৯৬৮ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তরুণদের কাছে। La poesi est desormais dans la rue! এর অর্থ হলো, কবিতা এখন রাজপথে।

কবিতাই যখন রাজপথে, তখন আমাদের লেখা আর কী গুরুত্ব বহন করে? ইতিহাস লেখা হয়ে চলেছে প্রতিদিন তরুণদের মুখে মুখে, স্লোগানে স্লোগানে, ফেসবুকের দেয়ালে, গ্রাফিতিতে।

শহীদ মিনারের সামনে লাখো কণ্ঠের প্রতিধ্বনিতে, রিকশাচালকের মুঠিতে, বৃষ্টি ভেজা তরুণীর ঠোঁটে। তাই নতুন করে কিছু লেখার স্পর্ধা হয় না আর। ক্ষমা চাই তোমাদের কাছে, আমাদের যে সত্যি স্পর্ধার বড় অভাব। 

তাই সেই নেরুদা থেকেই ধার করে বলি, যে কবিতা ছিল মৃত্যুকালে চে র শিয়রে, তার সেই সবুজ নোটবুকে—

যদি তুমি জিজ্ঞেস করো, কোথায় ছিলাম আমি

বলা দরকার তবে, ‘এমন ঘটেই থাকে।’

আমাকে বলতেই হবে পাথরকে কালো করা মাটির কথা 

যে নদী বহমানতাকে নিজেই ধ্বংস করেছিল: 

আমি শুধু সে সব বিষয় জানি পাখিরা হারায় যা, 

পেছনে ফেলা সমুদ্র, কিংবা আমার বোনের কান্না।’ 

তানজিনা হোসেন কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক