শিক্ষার সঙ্গে কর্মদক্ষতার সম্পর্কহীনতার সমস্যা শুধু মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়, বরং প্রকটভাবে উপস্থিত আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিষয়ে পড়া স্নাতকদের বেলাতেও। চাকরির বাজারে এসব বিষয়ের অনেকাংশে এখন চাহিদা নেই।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ শতাংশ স্নাতক বেকার। কী দেশ, কী শিক্ষাব্যবস্থা—অর্ধেকই বেকার!
বিআইডিএস জরিপে উঠে আসে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশই বেকার অবস্থায় রয়েছেন।
অন্য জরিপে দেখা গেছে, তাঁরা শিক্ষা সমাপ্তির পরে প্রায় তিন-চার বছর বেকার থাকেন। বেকার অবস্থায় থাকা তরুণর মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি বিএ পাস করেছিলেন। ২৩ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে স্নাতক অর্জন করেছেন। লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে পাস করেছেন প্রায় ২১ শতাংশ। বেকারদের ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পাস করেছেন ইসলামের ইতিহাস এবং বাংলায়। তবে ইংরেজি, অর্থনীতি ও হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক করা শিক্ষার্থীরা কম বেকার হয়েছেন। অর্থনীতি বা ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ের এবং হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও বেকারত্বের শিকার হয়েছেন, তবে কম।
এটা হাস্যকর যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়েন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হন এমন দেশে, যেখানে দিনের ভোট রাতে হয়, সব পর্যায়ের নির্বাচনে ভোট চুরির ঘটনা ঘটে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং ভারসাম্য নেই, এমনকি নেই কোনো উপলব্ধিও।
নির্বাচন ও ভোটাধিকারহীন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের দেশে রাষ্ট্র বিজ্ঞান পড়ে হাজারে হাজারে তরুণ বেকার থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সরকার ও রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণাও অনেক শিক্ষার্থীর তৈরি হয় না।
এ রকম বহু মানহীন বিষয়ে, নিম্নস্তরের কারিকুলামে, অযোগ্য শিক্ষকের অধীনে এবং ক্লাসহীন শিক্ষায়, চাকরি বাজারের প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক না থাকা বিষয়ে পড়িয়ে আমাদের ছেলেমেয়েকে শিক্ষার নামে সস্তা সার্কাসে ঠেলে দেওয়ার মহা আয়োজন হয়েছে।
শিক্ষার নামে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হচ্ছে, কারা পড়াচ্ছেন, কেন পড়ানো হচ্ছে—এসবের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি নেই বললেই চলে। প্রায়ই দেখা যায়, চাকরির পরীক্ষায় কেউ পাস করে না বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি মতে (১১ ডিসেম্বর ২০২৩), প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কেউই কাট নম্বর পায়নি বলে (যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায়) নবম গ্রেডের সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার পদের নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে। এ রকম প্রায়ই হয়।
হাজারে হাজারে, লাখে লাখে চাকরির আবেদন কিন্তু দক্ষতাসম্পন্ন যোগ্য প্রার্থী নেই। এটা জিপিএ-নির্ভর অসার শিক্ষাব্যবস্থার অনিবার্য ফল! এমন খবর দেখলে মনে হয়, শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে গেছে।
সহজ প্রশ্ন, উদার মূল্যায়ন, অটো পাস, জিপিএ-৫, প্রশ্নপত্র ফাঁসের চর্চা প্রতিষ্ঠিত করে, গণিত ও বিজ্ঞানশিক্ষাকে সংকুচিত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় পাস মার্কস পাওয়া শিক্ষার্থী মাত্র ১০ শতাংশের আশপাশেই থেকেছে। অথচ যাঁরা পরীক্ষায় অংশ নেন, তাঁদের অধিকাংশই জিপিএ-৫ বা এর খুব কাছাকাছি পাওয়া।
আমাদের বেসরকারি খাতে দক্ষতাকেন্দ্রিক চাকরির বাজারে বিদেশিরা এমন উচ্চ হারে ঢুকছে, যা দেশের চাকরির বাজার ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের অনুকূল নয়।
উচ্চশিক্ষিত বেকার দেশের জন্য বড় বোঝা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে গোনা বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে পড়ে এসব পড়ালেখা চাকরিতে প্রয়োগ করা যায় না। শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ চাকরি না পেয়ে নিজেদের পড়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, উদ্যোক্তা হয়ে আয় করেন, যার জন্য আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে।
কথা ছিল, বিদেশিরা নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির খাতে দেশের চাকরি বাজারে দু-তিন বছরের জন্য ঢুকবেন, এ সময়ে নলেজ ট্রান্সফার করে স্থানীয় রিসোর্স ডেভেলপ করা হবে। কর্মদক্ষতা এবং টেকনোলজি ট্রান্সফার বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো কার্যকর কৌশলগত পরিকল্পনা নেই।
বাংলাদেশে এত এত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অথচ দেশে রাজনৈতিক সমস্যার অন্ত নেই এবং মূলত প্রায় সব সমস্যাই রাজনৈতিক। দেশে এত ইতিহাসবিদ অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিথ্যার মধ্যে বড় হচ্ছে। দেশে এত সমাজবিজ্ঞান কিংবা সমাজকল্যাণ স্নাতক, অথচ সমাজে কার্যকর কোনো কল্যাণ নেই।
দেশে এত এত সমাজবিজ্ঞানী, সমাজে তার প্রভাবের লেশমাত্র নেই। দেশে এত আইন পড়ুয়া বিজ্ঞ আইনজীবী, অথচ আইনের শাসন নেই, জুলুমের আইনি প্রতিকার নেই। অর্থনীতিবিদের অভাব নেই, অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল পায় না জনগণ। তাহলে এই পড়াশোনার ফায়দা কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোর কোনো চাহিদা সমাজ ও রাষ্ট্রে নেই। বাস্তবতা হচ্ছে শুধু পলিটিক্যাল ক্যাডার সৃষ্টির জন্য এসব বিষয় চালু আছে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি করে, চাঁদাবাজি মস্তানি মারামারি করে বেড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষে এঁরা জাতীয় বোঝা, এঁদের প্রধান ব্যবসা হয় সরকারি তদবির, ঘুষের দালালি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি নিয়ে চুরি করা।
এক দল আছে যেকোনো বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে যায়, দক্ষতার সঙ্গে এদের কোনো সংযোগ ঘটে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে গণহারে বিবিএ, এমবিএ কোর্স। এসব কোর্সের আসনের সঙ্গে চাকরির বাজার বা ইন্ডাস্ট্রি-চাহিদার কোনো ম্যাপিং নেই।
উচ্চশিক্ষিত বেকার দেশের জন্য বড় বোঝা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে গোনা বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে পড়ে এসব পড়ালেখা চাকরিতে প্রয়োগ করা যায় না। শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ চাকরি না পেয়ে নিজেদের পড়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, উদ্যোক্তা হয়ে আয় করেন, যার জন্য আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রথম আলোর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ পাতায় নানা সময়ে তরুণদের সফলতা ছাপানো হয়। সেখানে দেখা যায়, তরুণদের কেউ বিরিয়ানি রান্না করে পৌঁছে দিচ্ছেন, কেউ খাতা বানিয়ে বিক্রি করছেন, কেউ শিঙাড়া-চপের দোকান দিয়েছেন, কেউ ক্যাকটাস বিক্রি করছেন, আবার কেউ মাছ-মাংস কেটে-ধুয়ে রান্নার উপযোগী করে সরবরাহ করছেন। কেউ ভারত-পাকিস্তান থেকে কাপড় এনে, চীন থেকে বিভিন্ন পণ্য এনে ফেসবুক লাইভে এসে বিক্রি করছেন।
কাহিনিগুলো অসংখ্য বেকার তরুণকে উৎসাহিত করবে সন্দেহ নেই। যাঁরা এসব কাজ করছেন, তাঁদের সবাই উচ্চশিক্ষিত বেকার। সৎ থেকে করা প্রত্যেকটা কাজই সম্মানের, কর্ম তৈরির জন্য এবং সমাজের জন্য দরকারি। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কেন চাকরির চাহিদা না থাকা বিষয়ে এত বেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি করছে, পাবলিক মানি নষ্ট অর্থাৎ আসন নষ্ট করবে কেন?
আসলে দক্ষতার বিপরীতে শিক্ষার নাম শুধু অপশিক্ষায় নামিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের বেকারত্ব উপহার দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা উদ্দেশ্যহীন বিষয়ে পড়ছেন, আসলে অনেকে না পড়েই পাস করছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেকার উৎপাদনকারী বিষয়গুলোকে দেশের মাত্র কয়েকটি কলেজে সংকুচিত করে, আসনগুলোতে বাজার চাহিদানির্ভর শিক্ষা (লেখকের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ বইতে আলোচ্য) কারিকুলামনির্ভর শিক্ষার নতুন নতুন বিষয় আনা লাগবে, চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ে আসন বাড়াতে হবে—যেখানে চাকরির বাজারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা প্রাধান্য পাব। কারিগরি ও শিল্প দক্ষতা উৎপাদনকে সেন্টার পয়েন্ট ফোকাস করা হবে।
এমনকি সামাজিক বিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, ইংরেজি ও বাংলার মতো বিষয়ে পড়লেও শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা তৈরি জন্য দরকারি আধুনিক কারিগরি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং ইন্ডাস্ট্রি ট্রেনিং দিতে হবে।
আমাদের শিক্ষা দক্ষতা তৈরি করতে পারছে না। অন্তত আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি দল কি ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থার দক্ষতাভিত্তিক রূপান্তরের প্রতিজ্ঞা করবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। ই-মেইল: [email protected]