জার্মানির বাভারিয়া অঙ্গরাজ্যের ফুর্থ শহরে ১৯২৩ সালের ২৭ মে একটি জার্মান ইহুদি পরিবারে হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জারের জন্ম হয়েছিল। তাঁর সেই জন্মগ্রহণের মধ্যে কোনো বিশেষত্ব ছিল না। কারণ, সেদিন তিনি অতি সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু গত বুধবার তিনি যখন ১০০ বছর বয়সে মারা গেলেন, তখন তাঁর মৃত্যু তাঁকে আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
১৯৩৮ সালে নাৎসি জার্মানির ইহুদি নিধন থেকে বাঁচতে ১৫ বছর বয়সে তাঁর পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউইয়র্কে পালিয়ে যান। মাতৃভাষা জার্মানকে অটুট রেখেই কিশোর হেইঞ্জ যখন মার্কিন নাগরিক ‘হেনরি’ হয়ে ওঠেন, তখন কেউ বুঝতে পারেননি, সেদিনের সেই কিশোর বড় হয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার আদেশ দেবেন এবং তার ফলস্বরূপ একজন কোটিপতি হয়ে যাবেন।
হেনরি কিসিঞ্জারের জীবন যে বর্ণাঢ্য ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ১৯৪৩ সালে ২০ বছর বয়সে মার্কিন সেনাবাহিনী তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য যুক্ত করে। ওই বছরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। মাতৃভাষা জার্মান হওয়ার কারণে তাঁকে মার্কিন সেনাবাহিনী জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকা এলাকায় পাঠিয়েছিল। সেখানে নাৎসি উৎখাত সংক্রান্ত একটি মার্কিন ইউনিটের তিনি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কিসিঞ্জার হার্ভার্ডে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে স্নাতক এবং ১৯৫২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।
১৯৫২ সালে তিনি পড়াশোনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাইকোলজি স্ট্র্যাটেজি বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছিলেন। যেসব দেশে সমাজতন্ত্র ছিল, সেসব দেশে ‘গণতন্ত্র’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্য ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই বোর্ড গঠন করেছিল। এটি হচ্ছে সেই সময়, যখন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ায় অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ কোরীয় নাগরিককে হত্যা করছিল।
হার্ভার্ডে যখন তিনি পড়াশোনা করছিলেন, তখন সেখানে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সভা–সেমিনারে যোগ দেওয়া অতিথিদের ওপর তিনি এফবিআইয়ের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতেন।
কিসিঞ্জার তাঁর একাডেমিক কাজে দেখাতে চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক যেকোনো ব্যবস্থার বৈধতা পাওয়ার জন্য শুধু একটি জিনিস দরকার। সেটি হলো পরাশক্তিগুলোর চুক্তি। তাঁর বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে নৈতিকতা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়।
মার্কিন নথি বলছে, কিসিঞ্জার কোথায় কতগুলো বোমার বরাদ্দ দিতে হবে, কোথায় কতগুলো বোমা ফেলতে হবে, তা ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। এই বোমাবাজি তাঁকে নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। তিনি এবং নিক্সন যখন উত্তর ভিয়েতনামে বোমা হামলা শুরু করেছিলেন, তখন কিসিঞ্জার ‘বোমার ক্রেটের সাইজ’ দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৫৫-৫৬ সালে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পারমাণবিক অস্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতির পর্যালোচক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তাঁর লেখা বই নিউক্লিয়ার উইপনস অ্যান্ড ফরেন পলিসি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে জয় নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভিত্তিতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষ হত্যায় এই ধরনের প্ররোচনা দেওয়ার কারণে সমালোচকেরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন, ‘ড. হেনরি কিলিঞ্জার’। ২০০০–এর দশকে শুরু হওয়া ভেঞ্চার ব্রোস নামের একটি মার্কিন কার্টুন শোর একটি চরিত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ড. হেনরি কিলিঞ্জার’।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে কিসিঞ্জারের নৃশংসতা পূর্ণ মাত্রা পেয়েছিল। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা বাড়িয়েছিলেন। জনসনের আমলে কম্বোডিয়ায় বোমা ফেলা শুরু হয়েছিল। কিসিঞ্জার এসে ১৯৭৩ সালে কার্পেট বোমা ফেলা শুরু করেন, যাতে কমপক্ষে দেড় লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। ওই বোমা হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হলে কিসিঞ্জার একবার তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, কম্বোডিয়ানদের নিয়ে সমালোচকেরা খুব বেশি মাতামাতি করছেন।’
মার্কিন নথি বলছে, কিসিঞ্জার কোথায় কতগুলো বোমার বরাদ্দ দিতে হবে, কোথায় কতগুলো বোমা ফেলতে হবে, তা ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। এই বোমাবাজি তাঁকে নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। তিনি এবং নিক্সন যখন উত্তর ভিয়েতনামে বোমা হামলা শুরু করেছিলেন, তখন কিসিঞ্জার ‘বোমার ক্রেটের সাইজ’ দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।
শুধু মনমানসিকতার দিক থেকে নয়, জবান চালানোর দিক থেকেও কিসিঞ্জার ছিলেন ভয়ানক আক্রমণাত্মক। একজন কূটনীতিক হয়ে তিনি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘দুশ্চরিত্রা’, ‘ডাইনি’ বলেছিলেন। তিনি ভারতীয়দের ‘জারজ’ বলে গালি দিয়েছিলেন।
এই কূটনীতিক বহু দেশের সরকার উৎখাতের নেপথ্য খলনায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) গণহত্যা চালাতে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক সুহার্তোকে পূর্ব তিমুরে গণহত্যা চালাতেও মদদ দিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। একইভাবে পৃথিবীর বহু দেশে বহু গণহত্যার নেপথ্যে ছিলেন তিনি।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, সেই কিসিঞ্জার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক উভয় শিবিরের চোখে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীরাও তাঁর নৃশংসতার কথা ভুলে গিয়েছেন।
ট্রাম্প থেকে ওবামা, বুশ থেকে বিল ক্লিনটন—প্রত্যেকের সঙ্গে কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল।
আজকের ফিলিস্তিনিদের যে দুর্দশা, তার প্রধান নকশাকার ছিলেন এই কিসিঞ্জার। মূলত তাঁর পরিকল্পনাতেই ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের দমননীতি ও পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ভিত্তি তিনি গড়ে গিয়েছিলেন।
কিসিঞ্জার মারা গেলেন ২৯ নভেম্বর। নিয়তির পরিহাস হলো, এই দিন ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস।
জোসেফ মাসাদ নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে আধুনিক আরব রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত