জনরোষের মুখে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের শাসক শেখ হাসিনার নিজ বাসভবন থেকে হেলিকপ্টারে চেপে পলায়নের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দৃশ্যত একটি ইস্পাতকঠিন শাসনব্যবস্থাও জনগণের শক্তির কাছে নাজুক হয়ে পড়তে পারে। আর হাসিনা তো ১৫ বছর ধরে ক্রমাগত চরম স্বেচ্ছাচারী হয়ে দেশ শাসন করছিলেন।
বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়েছে, তার সর্বশেষ নিদর্শনও হলো হাসিনার এই পতন ও পলায়ন। তবে বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে, তাতে এখনই একে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য একটি বিজয়ঘণ্টা হিসেবে অভিহিত করা অপরিপক্বতার শামিল হবে।
আসলে বছরটা একটি কঠিন ও ভঙ্গুর সময়কাল হিসেবে যাবে, বছরের শুরুতেই তার আভাস দেওয়া হয়েছিল কিছু সুসংহত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। বার্লিন প্রাচীর পতনের পর থেকে ২০ বছর ধরে দুনিয়াজুড়েই গণতন্ত্রের একটা প্রবাহ বিরাজমান ছিল। তার পর থেকে বহুত্ববাদের চেতনা ক্রমে দুর্বল হতে শুরু করে এবং তা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও।
পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্রগুলো আরও তেজি হয়ে ওঠে। চীন ও রাশিয়া ভিন্ন ভিন্ন পথে আরও কট্টরপন্থী হয়ে ওঠে। তাদের মিত্র ও অনুগত রাষ্ট্রগুলোও বিষয়টি খেয়াল করেছে। ফলে গণতন্ত্রের পতন না ঘটলেও তা বেশ গোলমালের মধ্যে পতিত হয়।
তারপরও কথিত গণতন্ত্রের বছরের মাঝামাঝি এসে যখন সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন, তখন একটা কূট বয়ানের আবির্ভাব ঘটেছে। যদি এর কোনো অভিন্ন প্রতিপাদ্য থাকে, তাহলে সেটা হলো ক্ষমতাসীনদের সরে যেতে বাধ্য হওয়া।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো প্রতিষ্ঠিত উদার গণতান্ত্রিক দেশেই হোক, কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলসমৃদ্ধ ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উচ্ছ্বাসময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, অথবা ভেনেজুয়েলা ও তুরস্কের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশই হোক; প্রায় সর্বত্র একের পর এক জাতীয় নির্বাচনে (তুরস্কে স্থানীয় সরকার) এটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
এখন বাংলাদেশেও এটি ঘটল। যখন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের প্রথম নির্বাচনটি এ দেশে অনুষ্ঠিত হলো, তখন তা একটি নির্মম নির্বাচনী বছরের ইঙ্গিত দিল।
শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় থাকার অধিকার পেলেন একটি নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত তো ভোটারদের কথাই শেষ কথা। তাঁরা হয়তো ব্যালট বাক্সের সাহায্যে হাসিনাকে অপসারণ করতে পারেননি, তবে রাজপথে নেমে তা করেছেন।
ধূর্তরা জানেন যে তাঁদের টিকে থাকার দুটি মূল সূত্র আছে—সেনাবাহিনীকে পাশে রাখা ও জনগণকে খাওয়াপরা দেওয়া। শেখ হাসিনার পতন তো ইতিহাসের অন্যতম স্বৈরশাসকের হেলিকপ্টারে চেপে পলায়নেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে রোমানিয়ার দীর্ঘকালীন অত্যাচারী শাসক নিকোলেই চসেস্কুও এভাবে পালিয়েছিলেন (এবং ধরা পড়েছিলেন)।
উদ্দীপনামূলক হলেও বাংলাদেশের অভ্যুত্থান আপনা-আপনিই বৈশ্বিক গণতন্ত্রের ওপর থেকে মেঘের আবরণ সরিয়ে দিতে পারবে না। নাইজেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ওলাসেগান ওবাসানজো আফ্রিকায় পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের বিষয়ে হতাশা ছড়িয়ে পড়া নিয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
কেনিয়া ও নাইজেরিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের তো রাজপথের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ থেকে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে ব্যালট বাক্সে ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও তা যথেষ্ট নয়।
আর এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন তো সামনে রয়েছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রার্থী রয়েছেন রিপাবলিকান পার্টি থেকে, যিনি নিজে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস যদি এখন এ বছরের আলোচিত চরিত্র নির্বাচন করতে চায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবেন ‘ভোটাররা।’
প্রশ্ন হলো, এসব দেখেশুনে একজন স্বৈরশাসক কী ভাবতে পারেন? ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার তো এখন তাঁদের রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ানো ও নিয়ন্ত্রণ আরোপকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি সুযোগ করে দিয়েছে ব্যবসা ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগসাজশ বাড়ানোর। ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় পশ্চিমাদের বিপর্যয়ের পর বিশ্বের কিছু এলাকায় ওয়াশিংটনকে এখন বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তবে স্বৈরশাসকেরা কিন্তু ‘ক্ষমতাসীনদের সরে যাওয়ার’ মহামারি থেকে সুরক্ষিত নন।
ধূর্তরা জানেন যে তাঁদের টিকে থাকার দুটি মূল সূত্র আছে—সেনাবাহিনীকে পাশে রাখা ও জনগণকে খাওয়াপরা দেওয়া। শেখ হাসিনার পতন তো ইতিহাসের অন্যতম স্বৈরশাসকের হেলিকপ্টারে চেপে পলায়নেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে রোমানিয়ার দীর্ঘকালীন অত্যাচারী শাসক নিকোলেই চসেস্কুও এভাবে পালিয়েছিলেন (এবং ধরা পড়েছিলেন)।
যাঁদের স্মৃতিশক্তি জোরালো, তাঁরা মনে করতে পারেন যে বুখারেস্টে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয়ের বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হওয়ার সেই দৃশ্য; আর সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যখন লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল, ‘সেনারা আমাদের সঙ্গে আছে।’ যে সেনাবাহিনী কয়েক দিন আগেও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, তারাই জনগণের পাশে দাঁড়াল।
বাংলাদেশেও বাঁকবদলের মুহূর্তটি আসে, যখন শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা সেনাবাহিনী এটা পরিষ্কার করে দেয় যে তারা প্রতিবাদী-বিক্ষোভকারীদের দমনে বল প্রয়োগ করবে না। এর বিপরীতে ভেনেজুয়েলার নেতা নিকোলাস মাদুরো এটা আগেই নিশ্চিত করেছিলেন যে সেনা নেতৃত্ব যেন নানা ধরনের লেনদেন ও দুর্নীতির জালে আটকে থাকে, যেমনটা দেখা যায় বেইজিং ও মস্কোতে, যদিও তা ভিন্নমাত্রায়।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় সূত্রেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি তো কর্মহীন প্রবৃদ্ধি পরিচালনা করেছেন। অথচ স্বৈরশাসকেরা তলাবিহীন ঝুড়ি আগে থেকে দেখতে পান বলে টিকে যান। জিম্বাবুয়ের দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখযোগ্য। দেশটির একটা ঢিলা কপাট আছে। আর তা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সীমান্ত। এই সীমান্ত দিয়ে লাখ লাখ মানুষ কাজের জন্য ওপাশে পারি দিয়েছেন। আবার কীভাবে সর্বগ্রাসীবাদ ও (দুনিয়া থেকে) বিচ্ছিন্নতা স্বৈরশাসককে টিকিয়ে রাখে, তার চরম দৃষ্টান্ত হলো উত্তর কোরিয়া।
কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতেও (রাশিয়া, চীন ও ইরান) শাসকগোষ্ঠীকে জনগণের সঙ্গে একটা ধোঁয়াশাপূর্ণ বন্ধন বজায় রাখতে হয়।
ভ্লাদিমির পুতিন অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন যে তিনি যদি জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারেন, তাহলে তাঁর একটি নিবিড় সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হবে। তবে বাইরে তাঁর যাবতীয় অনমনীয়তা ও সামরিকায়নকৃত অর্থনীতির আপাতস্পন্দন সত্ত্বেও তিনি রাতে সহজে ঘুমাতে পারেন না।
আবার বেইজিংয়ের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয় যে ২০২২ সালে কোভিডের কারণে বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে জনতা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানালে চীনা সরকার পুরো ঘুরে গিয়েছিল।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গত সপ্তাহে তাঁদের বার্ষিক গ্রীষ্মকালীন রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অর্থনীতিকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। ঠিকই আছে। এটা তো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতার বিষয়। শেষ পর্যন্ত এটা তো (স্বৈরতন্ত্রের) টিকে থাকারও প্রশ্ন।
অ্যালেক রাসেল ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) বিদেশবিষয়ক সম্পাদক। এফটি থেকে বাংলায় (ঈষৎ সংক্ষেপিত) রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া