প্রতিবছর এ সময় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশ বা সালানা জলসা হয়ে থাকে। সাধারণত সালানা জলসাগুলো একেক বছর একেক জেলায় আহমদিয়াদের কেন্দ্রে হয়। নিরাপত্তার কারণে এভাবে সালানা জলসা আয়োজন করে থাকে আহমদিয়ারা, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কাছে কাদিয়ানি নামে পরিচিত।
এখন আহমদিয়াদের মুসলিম হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম, বিশেষত বৃহত্তর সুন্নি মুসলিমরা। যদিও এ নিয়ে দীর্ঘ ধর্মীয় আলাপ, বিতর্ক, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার ইতিহাস আছে। উপমহাদেশে এ নিয়ে আছে দীর্ঘ রাজনীতির ইতিহাসও। ধর্মীয় তাত্ত্বিক আলাপ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় নিয়ে এখানে কিছু বলতে চাই না। সেটি ধর্মীয় পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের কাজ। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আহমদিয়াদের অধিকারের বিষয়টি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হওয়ার সুযোগ নেই।
গত শুক্রবার (৩ মার্চ, ২০২৩) আগে-পরে কয়েক দিন পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর, হামলা চালানো হলো তা কল্পনাতীত। বারবার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের ওপর এমন সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হতে দেখছি আমরা। কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের উগ্রবাদী আচরণের কাছে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী এভাবে ‘শক্তিহীন’ হয়ে পড়বে, সেটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। আমাদের কারও অজানা নয়, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের শক্তি-সামর্থ্য কাদের কাছে সব সময় ম্রিয়মাণ থাকে এবং কাদের সঙ্গে যখন-তখন তাঁরা চড়াও হন আর কাদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য চলে সেটিও।
পঞ্চগড় জেলা সদরের আহমদনগরে শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাওয়া তিন দিনব্যাপী সালানা জলসা বন্ধে দু-এক সপ্তাহ থেকেই তৎপর হয় কিছু ইসলামি সংগঠন। আহমদিয়াদের জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনও করে তারা। ওই দিন পঞ্চগড়ে মহাসড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ করেন এসব সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। সেদিনই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে।
এর আগের শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) পঞ্চগড় সদরে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে একটি ধর্মীয় সমাবেশ হয়। সেটির পোস্টারে অতিথিদের নামের তালিকায় আছেন জেলা, পৌরসভা, উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের শীর্ষ নেতারা এবং উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে পঞ্চগড়ের প্রথম আলোর প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করি। অতিথির তালিকায় থাকলেও অনেকেই সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
তবে পঞ্চগড়ের ঘটনায় শুধু ইসলামি সংগঠন নয়, স্থানীয় রাজনীতিও যে যুক্ত ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি আরও প্রমাণিত হয় যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত আহমদিয়াদের কাছে যান রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। তিনি পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ সময় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন একত্রে চিৎকার করে রেলমন্ত্রীকে বলতে থাকেন, এই এলাকার (শালশিড়ি) বাড়িঘরে যাঁরা হামলা-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এখনো মন্ত্রীর আশপাশেই আছেন। এই হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা না হলে তাঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।
একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর শুধু সংখ্যাগুরুদের আক্রোশ যথেষ্ট নয়। সেখানে যখন আগে-পরে রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাপুষ্ট লোকজন জড়িয়ে পড়ে, তখনই একটি ‘সফল’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হামলার ঘটনা ঘটে। সেটি এই উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। সেখানে ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়াও রাজনৈতিক অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে, সেটি এ দেশে আমরা আগেও দেখেছি, বারবারই দেখেছি। সেই ধারাবাহিকতায় পঞ্চগড়েও দেখা গেল কি?
রেলমন্ত্রীর কোনো সদুত্তর না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা তাঁর সামনেই নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন এবং হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করেন। এতে কিছুটা হট্টগোল শুরু হয়। এ সময় রেলমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেন, ঘটনার সঙ্গে যে-ই জড়িত হোক, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মন্ত্রী সেখান থেকে চলে যান। ৭ মার্চ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আমরা দেখছি, মন্ত্রীর পাশে থাকা কারা কারা হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন, নাম ধরে ধরে তাঁদের দেখিয়েও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
যাঁরা এ সাম্প্রদায়িক হামলার নেতৃত্ব দিলেন, তাঁদের নিয়েই মন্ত্রী গেলেন ক্ষতিগ্রস্তদের এলাকা পরিদর্শনে। এমন দৃশ্য দেখার পর মরে যাওয়া ছাড়া আর কী চিন্তা মাথায় আসতে পারে ভুক্তভোগীদের? কতটা অসহায় হলে তাঁরা আত্মহত্যা করার কথা বলেন।
ভারতের দ্য ট্রিবিউন পত্রিকায় ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী আশীষ নন্দী বলছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দুই ধরনের মানুষ অংশগ্রহণ করে। প্রথমটি হচ্ছে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা, যারা অনেকটা দাঙ্গার নেতৃত্ব দেয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নানা কারণে তারা সংগঠিত হয়। এখন এ দেশে স্থানীয় দুর্বৃত্ত বলতে আমরা কাদের চিনি, সেটি নিশ্চয় খোলাসা করে বলার দরকার নেই। রেলমন্ত্রীর আশপাশে তাঁরাই তো ছিলেন, নাকি?
আমরা অবাক হই, সেখানেই কিনা রেলমন্ত্রী বলছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত চক্র এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে...একইভাবে ২০১৩-১৪ সালে গণতন্ত্রের নামে, রাজনীতির নামে জ্বালাও-পোড়াও করে, পুলিশের ওপর হামলা করে এবং সড়কে গাড়ি পোড়ানোয় লিপ্ত ছিল তারা।’ তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজন নেতা-কর্মীদের হামলাকারী হিসেবে আহমদিয়ারা চিহ্নিত করে দিলেন, আর তাঁদের নিয়ে কিছুই বললেন না বরং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে সেই ‘হামলাকারীদের’ নিয়ে নিরাপদে চলে গেলেন রেলপথমন্ত্রী।
একইভাবে সোমবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক সভা শেষে পঞ্চগড়ের ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলছেন, এ হামলার সঙ্গে জামায়াতের কর্মী ও বিএনপির নেতারা জড়িত। সেখানে নিহত একজনকে শিবির নেতা বলেও দাবি করেছেন তিনি।
এত বড় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে গেল। দুজন নিহত হলেন, যাঁদের মধ্যে একজন আহমদিয়াও, যাঁকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তিন দিন পরও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় না। কোনো ধরনের তদন্তের বাইরে গিয়ে দুই মন্ত্রীর মুখে একই ধরনের বক্তব্যে এমন বিষয় কি প্রকাশ পায় না—সরকারিভাবে বিষয়টিকে গতানুগতিক রাজনৈতিক কাদা-ছোড়াছুড়ির দিকেই নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে?
এ ঘটনায় মোট ১৬টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ১২ হাজারের বেশি। এখন পর্যন্ত ১৭০ জনের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপি-জামাতের কেউ যদি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তাদের কোনোভাবে ছাড় নয়। কিন্তু রেলমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা যেসব লোককে চিহ্নিত করে দিল আহমদিয়ারা, তাদের ধরা হবে কি?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম ধৈর্যের সঙ্গে ঘটনাটি মোকাবিলা করেছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ ঘটনার পরদিন শনিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আহমদিয়াদের বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ, প্রেস ও মিডিয়া বিভাগের সম্পাদক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, ‘তারা (মিছিলকারীরা) বাড়িগুলোতে আক্রমণ, লুটতরাজ এবং অগ্নিসংযোগ করে। এমতাবস্থায় প্রথম তিন ঘণ্টা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সহায়তা পাইনি। অত্র এলাকায় তাঁদের উপস্থিতি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তাঁরা নিষ্ক্রিয় থাকেন। এই বিষয়টি আমাদেরকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে।’
প্রথম আলো, সমকালসহ আরও সংবাদমাধ্যমে খবর ও ছবিতে আমরা দেখছি, হামলার আগে ওই এলাকার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি চিহ্নিত করতে লাল-সাদা কাপড় টাঙানো হয়েছিল। এতে দুর্বৃত্তরা সহজেই আহমদিয়াদের বাড়ি শনাক্ত করে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। সেই পতাকা বা কাপড়চোপড় সোমবার পর্যন্ত ঝুলতে দেখা যায়। হামলার ঘটনায় যখন এমন আলামত স্পষ্ট হয়, তাহলে বলতেই হয়, এ ঘটনা ছিল পরিকল্পিত।
ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার আলামত দেখে পঞ্চগড়ের পুলিশ প্রধানও বলছেন, ‘এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং একটি স্বার্থান্বেষী মহলের দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনার কাজ।’ আহমদিয়াদের প্রতিনিধি আহমদ তবশির চৌধুরীও বলছেন, যারা এসব কাজ করেছে, তাদের প্রশিক্ষিত মনে হয়েছে। হামলায় গ্রিল কাটা ও দেয়াল ভাঙারও যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আগন জ্বালানোর জন্য গানপাউডার আর পেট্রলও ব্যবহার করা হয়েছে।’ ( ৯ মার্চ, ২০২৩)
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কারা এই ‘প্রশিক্ষিত’ গোষ্ঠী। দীর্ঘ সময়ের ধরে পরিকল্পনা করল, অথচ কেউ কিছু জানতেই পারলো না! প্রশাসন বা সরকারের এতটা ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত হলো!
ধর্মীয় সংগঠনগুলোর উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি, প্রশাসন ও পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, হামলায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ, তদন্ত কমিটি না করা, বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া—সবকিছু মিলিয়ে দেখলে মনে হবে সংখ্যালঘু আহমদিয়ারা শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিকভাবেও শিকার হয়েছে।
একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর শুধু সংখ্যাগুরুদের আক্রোশ যথেষ্ট নয়। সেখানে যখন আগে-পরে রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাপুষ্ট লোকজন জড়িয়ে পড়ে, তখনই একটি ‘সফল’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হামলার ঘটনা ঘটে। সেটি এই উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। সেখানে ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়াও রাজনৈতিক অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে, সেটি এ দেশে আমরা আগেও দেখেছি, বারবারই দেখেছি। সেই ধারাবাহিকতায় পঞ্চগড়েও দেখা গেল কি?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী