কৃষক যদি এক বস্তা মরিচসহ ট্রেনে চড়ে বিনা ভাড়ায়ও দিল্লিতে ঢোকেন, তবে একজন কৃষকের সঙ্গে এক বস্তা মরিচও দিল্লিতে ঢোকে, যা ট্রাকে আনতে গেলে রেলভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে। ট্রাকের টায়ার বাঁচে, রাস্তা বাঁচে, ডিজেলের ভর্তুকিও বাঁচে।
একজন চাকরিজীবী যদি ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনে দিল্লিতে তাঁর অফিসে ঢোকেন, তবে তাঁর প্রাণশক্তি, বসবাসের খরচ দিল্লিতে থাকার চেয়ে অনেক বেশি বাঁচে, যা একদিক থেকে দেশের লাভ। একজন চাকরিপ্রার্থী যদি রেলে আসেন, তবে বাসে এসে ইন্টারভিউ দেওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি সতেজভাবে ইন্টারভিউ দিতে পারেন। একজন ছাত্র যদি ট্রেনে কলেজ ধরতে পারেন, তবে তিনি অনেক বেশি মনোযোগী হতে পারেন—এমনটাই বলেছিলেন ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব।
১.
১ হাজার ২০০ একর জমির ওপর ১৯৮৭ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের কাপুরথালায় যে রেলওয়ে কারখানা ভারত সরকার স্থাপন করে, তা প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০ কোচ উৎপাদন করে। অথচ ১৮৭০ সালে ১১০ একর ভূমির ওপর বাংলাদেশে সৈয়দপুর রেল কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত আধুনিকায়ন হয়নি। উল্টো যা যন্ত্রপাতি আছে, তা অব্যবহারে ধ্বংসের মুখে।
আর গত আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পকেরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা আধুনিকীকরণে মাত্র ১২২ কোটি ২২ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেন। পরে তা–ও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। পাহাড়তলী রেল কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০০৭ সালের জাপানের জেবিআইসি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার মিলে ১৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন প্রকল্পটির কাজই শুরু হয়নি।
এই দুই কারখানার ৮০ ভাগ যন্ত্রাংশই ব্রিটিশ যুগের। এগুলো অনেক আগেই উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে। এই দুই কারখানা চালু রেখে আমরা নিশ্চয়ই ব্রিটিশ দাসত্বের চিহ্ন বজায় রাখতে পারি না! লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) তৈরির লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৯২ সালের ১৪ মে পার্বতীপুরে ‘কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও ইঞ্জিন তৈরির উদ্যোগ কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি!
রাষ্ট্র তো গরিবকে দেখবে, বিত্তবানেরা দরকার হলে বিমানে যাবেন। সারা দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেনে দুটি কোচ সংযুক্ত করলে মোট লাগবে ৬০ থেকে ৮০টি কোচ। সেই লোকাল মেইলগুলো থেকেই সংগ্রহ করা যায়।
১৮৭০ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলপথকে ঘিরে ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠাকালীন শত শত মেশিনের শব্দ ও কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর পদচারণে মুখর ছিল। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ‘রিকভারি প্রোগ্রাম’–এর আওতায় রেলওয়ের লোকবল ৫৮ হাজার থেকে ৩৫ হাজারে নামিয়ে আনা হয়। বিশেষত কমিয়ে আনা হয় কারখানাশ্রমিকদের। যেমন প্রতিষ্ঠাকালীন সৈয়দপুর কারখানায় মঞ্জুরিকৃত পদ ছিল ৪ হাজার, তা ২০০৩ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৬২১ জনে।
পার্বতীপুর রেল কারখানায় মঞ্জুরিকৃত পদ ১ হাজার ৬৯৯ জনের বিপরীতে আছেন ১ হাজার ৩৬ জন। আর পাহাড়তলীতে ২ হাজার ১২৮ জনের বিপরীতে আছেন ১ হাজার ২৩৩ জন। অর্থাৎ সব কটি কারখানাই ৪০ ভাগ কম লোকবল নিয়ে চলছে। শুধু লোকবলের ঘাটতির কারণেই ইঞ্জিন, ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামতের সুযোগ থাকলেও অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও বাইরে থেকে মেরামত ও আমদানি করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে যাঁরা কর্মরত আছেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দপুর কারখানার কর্মচারীদের ৭০ ভাগ ও শ্রমিকদের ৯০ ভাগের বয়স ৫০। এটা ২০১৫ সালের কথা।
২.
বর্তমানে ইঞ্জিনগুলোয় আরও ৩ থেকে ৪টি কোচ জুড়ে রেলকে আরও লাভজনক করা যায়। কয়েক দিন আগে এটা নিয়ে রেলসচিব ও ডিজির সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। সচিব মহোদয় বললেন, রাষ্ট্র তো গরিবকে দেখবে, বিত্তবানেরা দরকার হলে বিমানে যাবেন। ডিজি মহোদয় লোকাল কোচ আন্তনগরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কারিগরি সমস্যা দেখালে সচিব ওয়ার্কশপে প্রয়োজনীয় মেরামত করে নিতে পরামর্শ দেন।
সারা দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। প্রতিটি ট্রেনে দুটি কোচ সংযুক্ত করলে মোট লাগবে ৬০ থেকে ৮০টি কোচ। সেই লোকাল মেইলগুলো থেকেই সংগ্রহ করা যায়। শুধু হালকা মেরামত করে নিলেই হবে। ফলে বাড়তি খরচের ঝামেলা নেই। লালুপ্রসাদ যাদবরা এভাবেই ভারতীয় রেলকে লাভজনক করেছেন।
শ্যালো ইঞ্জিনগুলো ছিল কথিত সবুজ বিপ্লবের ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য আর আমাদের জেলে-মাঝিরা সেগুলো নদী পারাপারে কাজে লাগিয়েছেন।
মিটারগেজে শোভন বা স্নিগ্ধা কোচে যেখানে ৫৪টি সিট জায়গা দেয়া যায়, সেখানে সুলভ কোচে তার দ্বিগুণ আসন তৈরি করা সম্ভব। এতে শোভন কোচে যেখানে ভাড়া ৬০০, সুলভে তা ৩০০ করা যায়। এই সুলভের সিট বরাদ্দ থাকবে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জন্য। তাতে বর্তমান সরকার যে গণ–অভ্যুত্থানের সরকার, তা আরেকবার প্রমাণ হবে।
নাহিদ হাসান, লেখক ও সংগঠক